পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৯৮

 পরের দিন ২৯শে এপ্রিলের দুপুর। আমার সহকর্মী কমাণ্ডারদের নিয়া নতুন পরিকল্পনা সম্বদ্ধে আলোচনার্থ সবেমাত্র ডাকবাংলায় বসিয়াছি এমন সময় হঠাৎ কয়েকটি গোলার শব্দ শোনা গেল। আমার আলোচনা স্থগিত করতঃ বাহির হইয়া পড়িলাম। অবস্থা আঁচ করিতে না করিতেই আরও কয়েকটা শেল আমাদের ডাইনে- বাঁয়ে- পিছনে আসিয়া পড়িল, বুঝিতে বাকী রহিল না দুশমনের প্রত্যক্ষ আক্রমণ অত্যাসন্ন। কমাণ্ডাররা যে যার স্থানে চলিয়া গেলেন। ইতিমধ্যে দুশমনের একটি গোলা আমাদের একটি গাড়ীর উপর আঘাত করিল এবং তাহাতে আগুন ধরিয়া গেল। গাড়ীটিতে খানসামায় দুশমনদের নিকট হইতে আটককৃত গোলাবারুদ রক্ষিত ছিল, উহার পাশ্বেই আমার জীপগাড়ীটিও ছিল, কোনমতে তাহা সরাইয়া নিতে সক্ষম হইলাম। আমরা শত্রুর আক্রমণের জবাব দিতে লাগিলাম। চার ঘণ্টা ঘণ্টা ধরিয়া চলিল, সুবেদার আবুল হামেশসহ কয়েকজন আহত হন। ইহাদেরকে পরে হাসপাতালে পাঠানো হয়। অবশেষে ট্যাঙ্কসহ শত্রুবাহিনী আমাদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে এবং আমরা পশ্চাদপসরণ করিতে বাধ্য হই। এইবার আরও হাতিয়ার গেল, গোলাবারুদ গেল, বাহিনীর বহু লোক পালাইয়া গেল। নায়েক সুবেদার খালেক ও সুবেদার হাফেজ সাহসে ভর করিয়া ঐ দিন সন্ধ্যায়ই কিছু লোকজনসহ ভজনপুর গিয়া পৌঁছিলেন। এপ্রিলের ২০ তারিখের ভোর হইতে না হইতে তাহারা ভজনপুরে ঘাঁটি নির্মাণের কাজ শুরু করিয়া দিলেন। আমি তাহাদেরকে যথারীতি উপদেশ দিয়া নানা জরুরী কাজে ও বিচ্ছিন্ন লোকদেরকে জড় করার উদ্দেশ্যে পিছনে গেলাম। এই দিকে দুশমনরাও অতি তাড়াতাড়ি জগদল এবং ওমরখানায় তাহাদের শক্ত ঘাঁটি গাড়িয়া বসিল। ওমরখানা পর্যন্তই শেষ ঘাঁটি ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা বিদ্যমান ছিল।

 তারপর ঐ মাসের অর্থাৎ এপ্রিল মাসের এক শুভক্ষণে জানিতে পারিলাম যে স্বাধীন বাংলার সরকার গঠিত হইয়াছে। এমতাবস্থায় মে মাসের ৮ তারিখ আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রধান তদানীন্তন কর্নেল এম এ জি ওসমানী আমাদেরকে ভারতের কদমতলায় ডাকিয়া পাঠান। সেখানে এক জরুরী সভা হইল। তাহাতে যোগ দিলেন ক্যাপ্টেন নজরুল হক, ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ এবং কয়েকজন ভারতীয় অফিসার। মুক্তিবাহিনী প্রধান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হইতে যুদ্ধের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করিলেন। এরপর তিনি তার পরিকল্পনা অনুসারে আমাদিগকে নির্দেশ দান করিলেন। আমরাও আমাদের অভাব অভিযোগ জ্ঞাপন করিলাম, তিনি যথাসাধ্য পূরণ করিবার আশ্বাস দিলেন। উক্ত সভায় তিনি ক্যাপ্টেন নজরুল হক সাহেবকে আমার ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার অর্পণ করিলেন। তরপর ঐ দিনই সন্ধ্যায় তিনি আমাদের ভজনপুর ঘাঁটিতে আগমন করিলেন। তাহার দর্শন লাভে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় আমরা আরো সতেজ হইলাম, তার উপদেশের মাধ্যমে পথের দিশা পাইলাম। অধিকন্তু তিনি ক্যাপ্টেন নজরুল সাহেবকে আমাদের অধিনায়ক রুপে নিয়োগ করায় আমরা আরো উৎসাহিত হইলাম। এর কিছুদিন পর প্রধান সেনাপতি আবার ভজনপুর আসিলেন, সঙ্গে বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। ইহাতে জোয়ানরা খুব খুশী হইল, তাহাদের মনোবল দৃঢ়তর হইল। ততক্ষণে ভারত হইতে অপ্রচুর হইলেও বিভিন্ন রকম সাহায্য আসিতে আরম্ভ করিয়াছে। অতএব মুক্তি সংগ্রামীদের মনোবল ঊর্ধ্বমুখী হইয়া উঠিল ৷

 ৯ই মে ক্যাপ্টেন নজরুল আমার ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহণ করিলেন এবং আমি তাহার সহকারী হিসাবে কাজ করিতে লাগিলাম। এ সময় দুশমনরা ওমরখানার জগদল এলাকায় দৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করিয়া ফেলিয়াছে। তাই আমরা আমাদের মূল ঘাঁটি ভজনপুরের ৩/৪ মাইল আগে মাগুরমারী ও ময়নাগুড়ি নামক স্থানে দুইটি পোষ্ট খুলিয়া দুইটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল পাঠানোর ব্যবস্থা করিলাম। ২৬শে এপ্রিল হাবিরদার দেওয়ানের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি ছোট দল প্রথম ওমরখানার কাছে মাগুরমারীতে পাঠানো হইয়াছিল। তাহারা দুশমনের গতিবিধি নিরীক্ষণ করিত এবং পিছনে আমাদেরকে খবর দিত। ৩০শে এপ্রিল শত্রুদের হঠাৎ আক্রমণে এই ছোট দলের ২ জন শহীদ এবং অন্য ২ জন গুরুতরভাবে আহত হইয়া হাসপাতালে নীত হয়। যাহা হউক, মাগুরমারীতে ক্রমান্বয়ে লোকসংখ্যা বাড়াইয়া শেষ পর্যন্ত দেড় কোম্পানীর মত করা হয়। এর এক কোম্পানী নতুন সি কোম্পানী নাম নিয়া নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলীর নেতৃত্বে দুশমনের ওমরখানা ঘাঁটির সন্নিকটে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। ২রা মে হইতে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ তাহারা সেখানে অবস্থান করে