পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩০১

সিগন্যাল ম্যানকে আহত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং সঙ্গে ২ টা চাইনিজ মেশিনগান ও ৫টা রাইফেল আমরা হস্তগত করি। এই সময় ১ টা জীপ ও ২ টা ডজ গাড়ী আমাদের হাতে আসে।

 পার্বতীপুরে বিহারীদের লুটপাট ও সংঘর্ষঃ অতঃপর এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে আমরা জানতে পারি যে পার্বতীপুরের বিহারীরা নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে ব্যাপক হারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করছে। তারা নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মভাবে হত্যা করছে। এই খবর পাবার পর আমি আমার প্লাটুন নিয়ে পার্বতীপুরের নিকটে গ্রামগুলির নিরাপত্তা বিধানের জন্য যাই। আমরা যাবার পর প্রায়ই বিহারীরা আমাদের উপরে গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে থাকে এবং সুযোগ বুঝে লুটপাট চালাতে থাকে।

 ১০ই এপ্রিল স্থানীয় হাজার হাজার লোক এসে আমকে জানায় যে বিহারীরা অত্যাচারের চরম সীমায় পৌঁছেছে। কাজেই তাদের যে কোন প্রকারে শায়েস্তা করতে হবে। তখন আমি হাজর হাজার জনতার সঙ্গে একত্রিত হয়ে আমার বাহিনী নিয়ে পার্বতীপুরের বিহারীদের উপার ঝাঁপিয়ে পড়ি প্রথম দিকে বিহারীরা আমাদের প্রতি গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে থাকে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা আমাদের গোলার মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে থাকে। বিহারীরা এই সময় লাইন ধরে য়ৈদপুরের দিকে যেতে থাকে। হিংস্র জনতা পলায়নরত বিহারীদের উপর চড়াও হয় এবং যাকে যাকে পায় পিটিয়ে মেরে ফেলে। ঐদিন আনুমানিক প্রায় ৪০০/৫০০ লোক মারা যায়। এই সময় পার্বতীপুর পুরাপুরি আমদের আয়ত্তে এসে যায়।

 ১১ই এপ্রিল সৈয়দপুর থেকে ৩ টনী ৩টা গাড়ী, ২টা জীপ বোঝাই খানসেনা পার্বতীপুর আসে এবং আমাদের উপর প্রবলভাবে গোলা বর্ষণ করতে থাকে ঐদিন সন্ধ্যার পর উভয় পক্ষ থেকে গোলাগুলি বন্ধ করা হয়। এই সময় আমাদের কাছে গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। সারা রাত্রি আমরা বহু জায়গায় যোগাযোগ করেও কোন গোলাবারুদ জোগাড় করতে পারিনি।

 ১২ই এপ্রিল সকাল ৮টার সময় সেনারা পুনরায় আমাদের অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই সময় তারা মর্টার থেকে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করে। কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর আমরা আর টিকতে পারি না, বাধ্য হয়ে পিছু হটতে থাকি। এখানে আমার একজন সিপাই মারা পড়ে এবং খোলাহাটিতে ৩নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাহেবের কাছে যাই এবং তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। কিন্তু সে জানায় যে, তার কাছে তেমন কোন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নাই। তখন বাধ্য হয়ে আমরা ফুলবাড়ী হেডকোয়ার্টারে চলে যাই। অতপরঃ আমি ফুলবাড়ী ক্যাম্প থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ওখান থেকে আরও জওয়ান ও আনসার নিয়ে আমি ১৫ই এপ্রিল পুনরায় পার্বতীপুরের দিকে যাত্রা করি। এবং আমরা পার্বতীপুরের আগের রেল স্টেশন ভাবানীপুরের হাওয়া গ্রামে ডিফেন্স করি।

 ১৬ই এপ্রিল খান সেনারা পার্বতীপুর থেকে ১টা ট্যাঙ্কসহ ভারী ভারী অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে সকাল ১১ টার দিকে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ১ ঘণ্টা প্রবল যুদ্ধ চলার পর খান বাহিনীর ট্যাঙ্কের গোলার মুখে পরপর আমার ৩ জন আনসারসহ ৫ জন সিপাই মারা যায়। এই সময় আমার সিপাই মোঃ হোসেনের মাথার উপর ১টা মর্টারের গুলি এসে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আমরা পিছু হটে ফুলবাড়ীর দিকে যাত্রা করি এবং এই সময় আমাদের পিছু পিছু খানসেনারা ফুলবাড়ীর দিকে যাত্রা করে।

 ঐ দিনই বিকাল প্রায় ৫টার দিকে খানসেনারা ফুলবাড়ীতে আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপর প্রবল আক্রমণ চালায়। এই সময় তারা ট্যাঙ্ক, মর্টার, কামান, মেশিনগান ব্যবহার করে। রাত ৮টা পর্যন্ত খানসেনাদের সঙ্গে চলে যাই। এই সময়ও আমাদের মনোবল অটুট থাকে।

 ১৮ই এপ্রিল খানসেনারা হিলি আক্রমণ করে। এখানে ভীষণ যুদ্ধের পর আমরা ভারতের দিকে চলে যাই।