পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩০২

সশস্ত্র প্রতিরোধে দিনাজপুর

সাক্ষাৎকারঃ হাবিলদার বাসারতউল্লাহ

১৬-১১-১৯৭৪

 ২৫শে মার্চ আমি দিনাজপুর ৪নং সেক্টর কুটিবাড়ীতে ৮নং উইং- এর 'সি' কোম্পানীতে ছিলাম। আমরা তখন উইং হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। ৮নং শাখার কমাণ্ডার ছিল মেরজ আমীন তারিক (পাঞ্জাবী)। সহ উইং কমাণ্ডার ছিল বাঙ্গালী নজরুল ইসলাম এবং অপরজন পাঞ্জাবী ছিল। উইং হেডকোয়ার্টারে ‘সি' কোম্পানী ছিল। কামণ্ডার ছিল আতাউল হক। 'বি' কোম্পানী হিলি এলাকাতে ছিল, কমাণ্ডার ছিল সুবেদার আবদুস শুকুর। ‘এ’ কোম্পানী ছিল চাপাসারে, কমাণ্ডার ছিল সুবেদার আখতারুজ্জামান। 'ই' কোম্পানী ছিল বিরলে, কমাণ্ডার ছিল সুবেদার বাদশা আহমদ (বিহারী)।

 দিনাজপুর সার্কিট হাউসে বেলুচ রেজিমেণ্টের এক প্লাটুনের কিছু বেশী পুরা আধুনিক অস্ত্রে জানুয়ারী থেকে অবস্থান করছিল। পাক আর্মির ৩ জন অয়ারলেস সেট নিয়ে উইং হেডকোয়ার্টারের মধ্যে থাকতো। ৩ জন আর্মির মধ্যে একজন বাঙ্গালী সিগন্যালম্যান ছিল। আমি ওখানে গেলে তারা কথাবার্তা বন্ধ করে দিত। বাঙ্গালী অপারেটরটি অপর দুজন পাঞ্জাবীকে ২৮তারিখ দুপুর তোমরা অগ্রসর হও আমি যাচ্ছি', এই বলে আমাদের সিগনাল সেণ্টারে আসে এবং বলে 'যদি পাকিস্তানীদের আক্রমণ করতে হয় তবে এখনই কারো, পাকসেনারা কিছুক্ষণের মধ্যে তোমাদের উপর আক্রমণ করবে।' আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আক্রমণের।

 হাবিলদার ভুলু মিয়া, নায়েক সুবেদার মোসলেম, সুবেদার মোমিনুল হক এদের নেতৃত্বে ২৮শে মার্চ রবিবার প্রায় ২টা ৪৫মিনিটে উইং- এর সকল অবাঙ্গালী ইপিআরদের উপর আক্রমণ করি। আমরা উইং এবং সেক্টর হেডকোয়ার্টার দখল করে নিই সন্ধ্যার মধ্যে। সকল অস্ত্র আমরা আমাদের আওতায় নিয়ে আসলাম। ঐ তারিখেই পাকসেনারা আমাদেরকে আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

 ৩১শে মার্চ পর্যন্ত আমরা কুটিবাড়ীতেই (উইং হেডকোয়ার্টার) ছিলাম। সীমান্ত এলাকার কোম্পানীগুলো কুটিবাড়ীতে চলে আসে। ৩১শে মার্চ বিকাল থেকে হাবিলদার নাজিমউদ্দিন ৬ পাউণ্ডার ছুড়তে থাকে পাক ঘাঁটির উপর। একই সাথে আমরা ব্যপকভাবে আক্রমণ করি। ঐ তারিখ রাতেই পাকসেনারা দিনাজপুর থেকে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা পার্বতীপুরের দিকে যায়। পথে বহু পাকসেনা জনতার হাতে নিহত হয়।

 নায়েক সুবেদার কাউসারের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন রংপুরের বদরগঞ্জ পৌঁছায়। সৈয়দপুর থেকে পাকসেনারা যাতে দিনাজপুরে না আসতে পারে সেজন্য বদরগঞ্জে ডিফেন্স নিই। আমাদের সামনে নদীর পাড়ে এক প্লাটুন মত বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অংশ ছিল।

 অনুমান ৮/৯ ই এপ্রিল বদরগঞ্জের পতন ঘটে পাক বাহিনীর হাতে। আমরা পিছু হটে ফুলবাড়ীতে আসলাম। ওখানে সুবেদার শুকুর সাহেব তার ফোর্স নিয়ে আগে থেকেই ছিল। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কিছু সৈন্যও ছিল। পরদিন আমরা দিনাজপুর চলে আসলাম। এরপর কাউঘর মোড়ে যাই। হাবিলদার আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে ঐ মোড়ে ডিফেন্স নিই। নায়েক সুবেদার মোমিনুল হক সাপোর্ট প্লাটুন নিয়ে আমাদের পিছনে থাকলো। ফুলবাড়ী- দিনাজপুর সড়কে আমরা ডিফেন্স নিলাম। এখান থেকে শিয়ালগাজী মাজারের পার্শ্বে নায়েক সুবেদার মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ডিফেন্স নিই।

 ১৩ই এপ্রিল সাড়ে ১২ টার সময় রাজবাড়ীর দিক থেকে শহরের পূর্বপাশ দিয়ে সৈয়দপুর-দিনাজপুর রাস্তার বাম দিক থেকে পাকবাহিনী আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্টিলারী ও ট্যাঙ্ক নিয়ে। পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে এখানকার বিভিন্ন আমাদের লোকেরা বিচ্ছিন্নভাবে পিছু হটতে থাকে। সন্ধ্যার পূর্বেই পাকসেনা দিনাজপুর শহর দখল করে নেয়।