পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

 বিকাল চারটার পর পুলিশ বাহিনীর গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে যায় এবং প্রায় সাতশ পুলিশ ভাই শহীদ হন। প্রায় সাড়ে তিনশ আত্মসমর্পণ করেন। বাকী সবাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। যে সমস্ত পুলিশ ভাই শহীদ হন তাদের লাশ পাঞ্জাবীরা পুলিশ ক্যাম্পের মাঠে একটা বিরাট গর্ত করে কবর দেয়। মেজর এনামের মুখে বিস্তারিত খবর নিয়ে আমরা পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পে যাই। সেখানে পাক হানাদার বাহিনী পিলখানার চতুর্দিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাখায় আমরা কিছুই দেখতে পারিনি। সেখান থেকে আমরা বিকাল চারটার সময় ক্যাণ্টনমেণ্টে ফিরে আসি।

 ক্যাণ্টনমেণ্টে পৌঁছে আমি গোছল করি। বিকাল ৫টার সময় আমার নায়েক সুবেদার ফজলুল করিম আমাকে জানায় যে, সেক্রেটারিয়েট অফিসের কয়েকজন পদস্থ কর্মচারী ৩টা বাসে পরিবারসহ ময়মনসিংহ সড়ক দিয়ে ময়মনসিংহ যাবার সময় (তাদের অধিকাংশই ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের অধিবাসী) পাঞ্জাবী ১৩এফ-এ রেজিমেণ্টে সৈন্যরা কুর্মিটোলা রেল স্টেশনের সম্মুখে যেখানে আর্মি ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছিল সেখানে উক্ত ৩টা বাস থামিয়ে বিবাহিত ও অবিবাহিত যুবতী মেয়েদেরকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখে এবং যুবক ও বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষদের মারধর করে তাদের বাস ছেড়ে দেয়। পরে যুবতী মেয়েদেরকে ক্যাণ্টমেণ্টে ১৯সিগনাল ব্যাটালিয়নে নিয়ে যায়। এবং পরস্পর শোনা যায় যে সেখানে মেয়েদেরকে ধর্ষণ ও অত্যাচার করছিল। এ খবর পাবার পর আমি লেঃ কর্নেল তাজ মোহাম্মদকে জানাতে যাই। লেঃ কর্নেল তাজকে না পেয়ে লেঃ কর্নেল সিনওয়ারীর (জিএসও-১ ইনটেলিজেন্স, জেড কোয়র্টার, ইস্টার্ন কমাণ্ড) নিকট যাই। তাকে না পেয়ে ১৪ ডিভিশন হেড কোয়ার্টার অফিসার মেসে যাই। সেখান থেকে টেলিফোনে মেজর হাজী মোঃ কেয়ানীকে (জি-২ ইনটেলিজেন্স ১৪ ডিভিশন) নারী ধর্ষণ ও অত্যাচারের কথা জানাই। আমার কথা শুনে মেজর হাজী কেয়ানী সাহেব অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে তার করার কিছু নেই। কেননা ইতিপূর্বেও তিনি অনুরূপ কয়েকটি ঘটনার কথা শুনেছেন। তিনি বলেন, এ সমস্ত জঘন্য কার্যকলাপের জন্য কয়েকজন অফিসারই দায়ী। এবং বর্তমানে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়েছে যা তাঁর পক্ষে বা অন্য কোনো অফিসারের পক্ষেও আয়ত্তে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা কতিপয় অফিসারের দোষেই সৈন্যরা বেশী প্রশ্রয় পেয়েছে। তিনি আমার কঠোর মনোভাব বুঝতে পেরে আমার নিকট তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করে ক্ষমা চান এবং আরও বলেন যে, আমি যেন লজ্জাজনক কথা বলে তাঁকে গুনাহগার না করি। মেজর হাজী মোঃ কেয়ানী সাহেবের সঙ্গে টেলিফোনে কথা শেষ করে আমার মেসে ফেরার পথে শহীদ আনোয়ার বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের এক ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডোর উপস্থিতিতে লেঃ জেঃ টিক্কা খানের ভাষণ শুনতে পাই। তখন বিকাল সাড়ে ছটা। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় আমার নায়েক সুবেদার ফজলুল করিম দুজন পাঞ্জাবীসহ জীপে আমার মেসে আসে। ফজলুল করিম আমাকে জানায় যে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। তাকে নির্দেশ দিয়েছে সার্ভে অব পাকিস্তান-এ (বর্তমান সার্ভে অব বাংলাদেশ) গিয়ে চট্টগ্রামের মানচিত্র আনতে। আমি তাক চুপে চুপে বললাম আমার ইউনিটে যে সমস্ত বাঙালী রয়েছে তাদের সবাইকে পালিয়ে যেতে। এবং ফজলুল করিম আমাকে জানাল যে তার সাথে দুইজন পাঞ্জাবী রয়েছে কাজেই সে কি করে পালাবে! আমি তাকে মানচিত্র নিয়ে আসার পর সুযোগ মত দেখা করতে বললাম। ফজলুল করিম চলে যাবার পর আমি চিন্তা করতে লাগলাম যে হঠাৎ এক ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডোর একত্রে উপস্থিত হওয়ার কারণ কি থাকতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত এই ধারনা হলো যে, তাদেরকে হয়তো বা কোথাও পাঠানো হচ্ছে এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারপর চট্টগ্রামের মানচিত্র সংগ্রহের কথা শুনে পুরোপুরি বিশ্বাস হলো যে, চট্টগ্রামের যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যরা বোধহয় আমাদের বাঙ্গালীদের নিকট পরাজিত হয়েছে এবং সে জন্যই মানচিত্রের সাহায্যে রাতে প্যারাসুটে তাদেরকে চট্টগ্রাম পৌঁছাবে। ইতিপূর্বে সন্ধ্যা সাতটার সময় ক্যাপ্টেন এনামের কক্ষে রেডিওতে আমরা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমান ব্রিগেডিয়ার) এর ভাষণ শুনতে পাই। বেতারে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর পক্ষ থেকে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সমস্ত বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর সদস্য, ইপিআর, বিমান বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও জনসাধারণকে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে চিরতরে এদেশ থেকে নির্মূল ও খতম করার আহ্বান জানান। এবং তিনি নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের সিইনসি ঘোষণা করেন। এ খবর শোনার পর আমরা কয়েকজন অত্যন্ত আনন্দিত হই এবং অনেক