পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩২২

 বেশ কিছুক্ষণ পরে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর শুনতে চাইলে কোন জবাব পাওয়া গেল না। বেশ কিছুক্ষন পর বলা হয় ইয়াহিয়া খান ভাষণ দেবেন। কিছুক্ষণ পর ইয়াহিয়ার ভাষণ শুনা গেল এবং সামরিক নির্দেশনাবলীও প্রচার করা হল।

 বিদ্রোহের দাবানল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। চারদিকে বিহারী-বাঙ্গালী দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেল; বিশেষ করে সান্তাহারে - যেখানে ছয় হাজার বিহারী বাস করত। আমরা দাঙ্গা বন্ধ করতে ছেষ্টা করছিলাম এবং এ নিয়ে মেজর নাজমুল হকসহ কিছু স্থানীয় এমসিএ এবং এসডিওর সাথে আমরা বৈঠক করি এবং যাতে লোকের মনে কোন সন্ত্রাসের সৃষ্টি না হয় তার চেষ্টা করি। ইয়াহিয়ার ভাষণ এবং সামরিক নির্দেশনাবলী শুনে আমাদের সেদিন ক্ষোভ এবং ভীতির সঞ্চার হয়।

 কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় যখন সন্ধ্যার সময় বেতার কেন্দ্র খুলি তখন হঠাৎ করে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। বেতারের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষনা করা হল। মনে সাহস হল যে অন্ততঃপক্ষে একজন অধিনায়ক হিসাবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব নিয়েছেন। সকলের মনে সাহসের সঞ্চার হল এবং আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরোপুরিভাবে ঝাপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলাম।

 আমি আমার অপারেশনাল হেডকোয়ার্টার অফিসে স্থাপন করলাম এবং মেজর নজমুল হকসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা শুরু করলাম। আমাদের পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে ছিল (কে) অয়ারলেস স্টেশন সারাদিন খোলা থাকবে এবং ইপিআর- এর ১৭উইং-এর খবরাখবর মনিটর করা হয় এবং সেগুলো অপারেশনাল হেডকোয়ার্টারে জানানো; (খ) নিজের হেডকোয়ার্টার থেকে কোন কথাবার্তা না বলা; শুধু শুনা; (গ) পুলিশের অয়ারলেসগুলোতেও মনিটরিংয়ের ব্যাবস্থা করা এবং সগুলোর মাধ্যমে যোগাযোগ করা; কেননা সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অবস্থা ছিল না; (ঘ) টেলিফোন ডিপার্টমেণ্টকে বলা হয় যেন বগুরা এবং যে সমস্ত রাস্তা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আসার সম্ভাবনা আছে সে সমস্ত জায়গায় অন্ততঃপক্ষে পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত কয়েকটা প্রধান জায়গার সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখে এবং সেখানকার স্থানীয় ছাত্রনেতা অথবা আওয়ামী লীগ নেতা যেন আমাদেরকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবগত রাখে তার ব্যবস্থা করে; (ঙ) সমস্ত গাড়ী বাস ট্রাক রিকুইজিশন করা হল; (চ) ছাত্রদের মধ্য থেকে ভলাণ্টিয়ার নেয়া হল এবং কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে ডাকা হল যেমন জনাব বয়তুল্লাহ (বর্তমান ডেপুটি স্পীকার) এবং ছাত্রনেতা মোহাম্মদ আবদুল জলিল কে ডাকা হল; (ছ) ছাত্রদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হল এবং তাদেরকে রাইফেল দেয়া হল; (জ) অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ স্টোর থেকে সরিয়ে কিছু কিছু মাটির নিচে রাখা হল যাতে করে জঙ্গী বিমানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; (ঝ) প্রধান হেডকোয়ার্টার-এর কিছু দূরে পেট্রোলিংয়ের ব্যবস্থা করা হল এবং খবরাখবর সরবরাহের জন্য রানার নিয়োগ করা হল; (ঞ) এবং স্থির হল যে এবং নওগাঁ কে আপাততঃ আমাদের রিয়ার হেডকোয়াটার করা হবে যেহেতু এটা হবে শত্রুবাহিনীর জন্য দূর্গম স্থান; (ট) এদিকে আমি ৬নং উইং ইপিআর যেটা রাজশাহী ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের অধীনে নওয়াবগঞ্জে অবস্থিত ছিল তাদেরকে অয়ারলেসে বাংলায় কিছু নির্দেশাবলী দিতে শরু করলাম। সেই উইংয়ে কোন বাংগালী অফিসার ছিল না। তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ছিল। ২৬/২৭শে মার্চের রাত্রের গোলযোগের পর তারা উইং হেডকোয়ার্টার ছেড়ে রাজশাহীতে পালিয়ে আসে। সেই সুযোগে আমি সমস্ত উইং-এর লোকজনকে নওয়াবগঞ্জে একত্রিত হতে বলি এবং বিওপি ছেড়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যেন সেখানে উপস্থিত হয় তার নির্দেশ দিই; (ঠ) সেখানে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ সরিয়ে ফেলে নিরাপদ জায়গায় রাখার নির্দেশ দিই। দেশের পরিস্থিতি সমন্ধে তাদের অবহিত করা হয় এবং তাদের উপর বিওপিতে হামলা হবার সম্ভাবনা আছে সেকথাও অবহিত করি।

 ২৭শে মার্চ পর্যন্ত আমাদের প্রস্তুতি চলে এবং রাজশাহী সেক্টরের নওগাঁ এবং নওয়াবগঞ্জের সমস্ত ইপিআরকে এক জায়গায় নিজ নিজ হেডকোয়ার্টারে একত্রিত করা হয়।