পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩২৪

 করে এর চরিদিকে ঘেরাও করে তাদেরকে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করতে হবে তার ব্যবস্থা করি। ঘেরাও করার জন্য গ্রাম থেকে কিছু লোক যোগাড় করা হল। এবং এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ঘেরাও করে গলোবারুদ বের করে নেয়ার জন্য নির্দেশনাবলী দিয়ে আমি আমার সুবেদার সাহেব কে রেখে নওগাঁ চলে 'আসি; যেহেতু আমার সেখানে যাবার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

 পরিকল্পনা অনুযায়ী এ্যামুনেশন ড্যাম্প ঘেরাও করা হয়েছিল এবং ক্যাপ্টেনতার লোকজন সহ আত্মসমর্পণ করে। অধিকাংশ গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে নিয়ে যায় এবং বাকিগুলো পানিতে ফেলে দেয়া হয়।

 বগুরা থাকাকালীন সময়ে অয়ারলেসে মেজর শফিউল্লাহর সাথে আমার কথা হয়। তিনি বললেন যে; কিশোগঞ্জের কাছে দ্বিতীয় ইষ্ট বেংগল নিয়ে যমুনা নদীর কাছে তিনি আছেন; আমরা যেন ওখানে গিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করি। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন; উত্তরাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার। সেখান থেকে একজন লোক পাঠিয়েছিলাম তাঁর কাছে। কিন্তু খবর পাওয়া গেল তিনি সিলেটের দিকে রওয়ানা হয়ে গেছেন।

 নওগাঁতে মেজর নজমুল হকসহ আবার পরিকল্পনা শুরু করলাম। এদিকে খবর পাওয়া গেল যে; ইপিআর কোম্পানী রাজশাহীর পথে মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাঠানো হয়েছে। সেটা রাজশাহীর নিকটবর্তী আড়ানী নামক রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ২৫ পাঞ্জাবের এক কোম্পানীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে-২৯/৩০ মার্চ রাতে তাদের সাতে কয়েকহাজার মুক্তিযোদ্ধা এবং গ্রামের লোক গোগ দিয়েছে। এই পাকিস্তানী কোম্পানীটি পাবনা থেকে পশ্চাদপসরণ করে তাদের নিজের ব্যাটালিয়ন-এর দিকে পদব্রজে রাজশাহী আসছিল। কোম্পানিটি সম্পূর্নরূপে ঘেরাও হয়ে যায় এবং ইপিআর কোম্পানী তাদের উপর ৩ ইঞ্চি মর্টার এর গোলা বর্ষন করতে শুরু করে। শত্রবাহীনী দিশেহারা হয়ে গোলাগুলি শুরু করে এবং অনেকক্ষণ গোলাগুলি বিনিময় হয়। শেষ রাতের দিকে শত্রুবাহীনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায় এবং প্রাণ বাঁচাবার উদ্দেশ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক সেদিক পালাতে শুরু করে। কিন্তু গ্রামের লোক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রায় সবাই ধরা পড়ে এবং তারা গ্রাম বাসিদের হাতে নিহত হয়। মেজর আসলাম এবং ক্যাপ্টেন রেজা (উপ অধিনায়ক) মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয় এবং আড়ানী স্টেশনের কাছে নিহত হয়।

 শত্রুবাহিনীর মনোবল খুবই ভেঙ্গে পড়ে এবং সেই সুযোগে আমি এক কোম্পানী ইপিআর নিয়ে নওগাঁ থেকে ৩১শে মার্চ রাজশাহীর পথে রওয়ানা হই। নওয়াবগঞ্জের উইংগকে নির্দেশ দিই তারা যেন নওয়াবগঞ্জ থেকে পদব্রজে অগ্রসর হয় এবং শত্রুও মোকাবেলা করতে যেন প্রস্তুত থাকে। অনেক ব্যারিকেড অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত রাজশাহীর অদুরে নওহাটা (মত্রঘাটি হতে মাত্র দুই মাইল দূরে) আমি আমার লোকজন নিয়ে অবস্থান নেই এবং অন্যদিকে অগ্রসরমান নওয়াবগঞ্জের ইপিআর উইং (যেখানে ৫০০সশস্ত্র লোক ছিল)-এর সাথে যোগাযোগ করি।

 সেই রাতে আমি কিছু লোক নওহাটায় রেখে রাজশাহী থেকে ছয় মাইল দূরে খরচক্কা (রাজশাহী- নওয়াবগঞ্জ রাস্তার উপর) নামক স্থানে ইপিআর-এ অগ্রসরমান লোকদের সাথে দেখা করি এবং সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীকে আমার অধীনে নিয়োজিত করি। সেই রাতে ২৫পাঞ্জাবের একটি পেট্রল বাহিনী তিনখানা গাড়ী নিয়ে সেই রাস্তায় আসে এবং আমাদের বাহিনী অতর্কিতে তাদেরকে এ্যামবুশ করে। আমরা ওদের ৭ জনকে নিহত এবং একজনকে জীবিত ধরতে সক্ষম হই। সেই বন্দীর কাছ থেকে জানা যায় যে ক্যাপ্টেন সালমান নামক এক অফিসার তাদের পেট্রল পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছিল এবং একটা প্লাটুন পেট্রলিংএ এসেছিল। ওদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং আহত-নিহতদের অধিকাংশকে নিয়ে চলে যায়। এতে আমাদের লোকজনের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। এবং আমার লোকজন ত্বরিত বেগে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়।