পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৪০

রহমানের অবস্থাও আমার চাইতে বিশেষ সুবিধেয় নয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি সম্পূর্ন নতুন। ৭০ সালেই নির্বাচনের আগে সক্রিয় রাজনীতেতে এসছেন এবং পার্লামেণ্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তবুও কর্তব্য সমন্ধে যেন হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠলেন; বললেন; এখন সকলকে ডেকে সিদ্ধান্ত নেবার সময় নেই। প্রতিটি মুহুর্তই মূল্যবান। সুতরাং আপনাকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে। “মকবুল সাহেব; অফিসার ইন-চার্য নিজামউদ্দিন সাহেব এবং থানার অন্যান্য পুলিশ কর্মচারীগণেরও একই মত। সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেললাম। হঠাৎ যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো “অল রাইট; আই এসিউম দি কমাণ্ড। উই শ্যাল রেসিস্ট দি পাকিস্তানী আর্মি।”

 কিছুক্ষনের জন্য আলোচনা হলো বগুড়া থেকে আট মাইল দক্ষিণে আড়িয়া ক্যাণ্টনমেণ্ট। রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্ট উত্তরে। মকবুল সাহেব বললেন; আড়িয়াতে পাকসেনার সংখ্যা খুব বেশী নয়। সুতরাং তারা হঠাৎ কিছু করবে না। তাছাড়া; অয়ারলেসে খবর এসেছে রংপুর থেকে পাক আর্মি আসছে। মনে পড়লো ২৫শে মার্চের সন্ধ্যার সময় ছত্রলীগের সামাদ এবং ছাত্র ইউনিয়নের রেজাউর রহমান ডিংগুর নেতৃত্বে বগুড়া আড়িয়া সড়কের মাঝখানে কটকির সংকীর্ণ পুলের উপর গাছ কেটে ফেলে এবং ইটের স্তূপ সাজিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিলো। সুতরাং শহরের উত্তরে বগুড়া-রংপুর সড়কের ব্যারিকেড দিতে হবে। ব্যারিকেড বাধা পেলে হয়তো রাতে তারা আর এগুবে না। শহরবাসীদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অন্ততঃ সকাল পর্যন্ত সময় চাই। (আমাদের চিন্তায় ভুল ছিলো না সেটা পরে প্রমাণিত হয়েছে। শহর থেকে তিন মাইল উত্তরে মাটিডালীতে ব্যারিকেড দেখে পাকিস্তানী সেনারা রাতে শহরে ঢুকতে সাহস করেনি)।

 দারোগা নিজামউদ্দিন এবং নুরউল ইসলাম তিনজন কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে রাইফেল হাতে নিৰ্দেশমত আজাদ গেস্ট হউসের ছাদে ঘাঁটি গাড়লেন। পাকিস্তানী সেনা রেললাইন পার না হওয়া পর্যন্ত তারা আক্রমণ চালাবেন না এই নির্দেশ তাদের দেয়া হলো পুলিশ ফোর্সের অন্যান্যদের অস্ত্রশস্ত্র পুলিশ লাইনে পাঠিয়ে দিলাম। মকবুল সাহেব চলে গেলেন অয়ারলেসে আর কোথাও যোগাযোগ করা যায় কিনা সে চেষ্টা চালাতে।

 থানা থেকে বেরোতেই দেখি থানার গেটে ২০/২৫ জন ছাত্র-যুবক জমায়েত হয়েছে। খবর তারাও পেয়েছে। তাদের নিয়ে ডাঃ জাহিদুর রহমান এবং আমি ছুটলাম উত্তর দিকে। যত দ্রুত সম্ভব মাটিডালী পৌঁছতে হবে। ব্যারিকেড দিয়ে প্রথম বাধার সৃষ্টি করতে হবে। শেষ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে শ্লোগান উঠলো। জাগো জাগো বীর বাঙ্গলী জাগো জয় বাংলা; বীর বাঙ্গালী হাতিয়ার ধরো; পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ করো।

 ছুটছি, রীতিমতো দৌড়াচ্ছি। পাকিস্তানী সেনারা যে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে সে রাস্তা দিয়ে ছুটছি। পাগলের মতো চীৎকার করছি সবই ঘুম থেকে জেগে উঠুন। পাকিস্তানী সেনারা আসছে। যাদের বন্দুক আছে, তারা বন্দুক হাতে বেরিয়ে আসুন। পাকিস্তানী সেনাদের ঠেকাতে হবে।

 মাটিডালী এসে পৌছলাম। শহর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। শ্লোগান দিতেই মুস্তাফিজুর (বাবু) সহ অনেকেই রাস্তায় বেরিয়ে এলো। ব্যারিকেড দেবার কথা বলতেই ১৫/২০ খানা কুড়াল নিয়ে গাছ কাটা শুরু হয়ে গেলো। রাস্তার দুপাশের লোকজনদের বাড়ী ছেড়ে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হলো (পাক সেনারা ব্যারিকেড দেখে ওখানকার অনেক বাড়ীই পুড়িয়ে দিয়েছিলো)। একট বিরাট গাছ রাস্তা জুড়ে পড়ার পর আবার ছুটলাম শহরের দিকে। মাটিডালিতে তখন আরো গাছ কাটা এবং ব্যারিকেড রচনার কাজ চলছে।

 ২৬শে মার্চের ভোর। পূর্ব আকাশে সূর্য মাত্র উকি দিয়েছে। ডাঃ জাহিদুর রহমানের বাড়ীতে সামনে রাস্তায় মাহমুদ হাসান খান একা দাঁড়িয়ে আছেন। মাহমুদ হাসান খান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর সবাই কোথায়? জিজ্ঞেস করতে ঘাড় নেড়ে জানালেন; জানেন না শুধু বললেন হাবিবুর রহমান (এমপি) আত্মসমর্পন করার পক্ষপাতী। (পরবর্তীকালে হাবিবুর রহমান পাক সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে তাদের সহযোগিতা করেছিলেন)।