পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৪২

দেয়ালের আড়ালে চলে যায়। হঠাৎ আঘাত পেয়ে বিচলিত পাক সেনা এলোপাতাড়ি গুলী চালাতে চালাতে এগিয়ে চলে। জামিলের বাড়ি পার হতেই আবার রাস্তার দু'পাশে দেয়ালের আড়াল থেকে পাকসেনাদের লক্ষ্য করে নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাদের আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে উঠলো। এখানে দজন পাকসেনা গুরুতর জখম হয়। কিন্তু বগগোলা পার হবার পর প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হলো পাকসেনা। ঝাউতলা বোম্বে সাইকেল স্টোরের পাশ থেকে গুলী করে সরে যাবার সময় গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলো আজাদ। স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে বগুড়ার মাটিতে আজাদই প্রথম শহীদ। উক্ত পাকসেনা রাস্তার পাশের ছোট চায়ের দোকানের ঝাপ তুলে দুটো কিশোর কর্মচারীকে গুলী করে মারলো।

 পাকসেনারা রেল লাইনের দু'নম্বর ঘুমটির কাছে আজাদ রেস্ট হাউসের ছাদ থেকে দারোগা নিজামউদ্দীন, দারোগা নুরুল ইসলাম এবং তাদের সহযোগীদের ৩০৩ রাইফেল গর্জে উঠলো। সম্মুখ দিক এবং দু' পাশ থেকে আক্রান্ত হয়ে হানাদার সৈন্যরা থমকে দাঁড়ালো। কিছুটা পিছু হটে এলো তারা। এমনি সময়ে বড়গোলার ইউনাইটেট ব্যাঙ্কের ছাদের ওপর থেকে তিনটি বন্দুক গর্জে উঠলো। উৎসাহের বলে নির্দেশ অমান্য করে সকলের অজান্তে ব্যাঙ্কের ছাদে পজিশন নিয়েছিলো টিটু, হিটলূ এবং মুস্তাফিজ(ছ)। দু'জন পাকসেনা জখম হলো। পেছন দিকে থেকে হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে হানাদার সেনাদল বিচলিত হয়ে পড়ে। পিছু হটে দ্রুত তারা ব্যাঙ্ক ভরনটি ঘিরে ফেলে। টিটু, হিটলূ এবং ছনু সরে যাবার সুযোগ পেল না। শহীদ হলো বগুড়ার আর তিনটি দামাল ছেলে। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ বর্বরহানাদার সেনারা দ্রুত পিছু হটে শহর ছেড়ে গেলো। সুবিলের উত্তর পাড়ে পূর্ব বিভাগের ডাকবাংলা এবং মহিলা কলেজে অবস্থান নিলো তারা।

 রাস্তায় বের হয়ে এলো বগুড়া শহরের লোক। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিনে আমাদের ছেলেরা প্রাণ দিয়েছে। সেজন্যে চোখগুলো অশ্রুসিক্ত। কিন্তু তার সঙ্গে মিলে আছে জয়ের আনন্দ, এক অভূতপূর্ব আশ্বাদ। বর্বর হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করেছি আমরা। তাদের হটিয়ে দিয়েছি, জয়ী হয়েছি।

 ২৬শে মার্চেরই অপরাহ্ণে একরামুল হক স্বপন; ফজলার রহমান (ফুলবাড়ী) এবং চন্দন এসে খবর দিলো যে তারা একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন যোগাড় করেছে। সুতরাং বুলেটিন সাইকক্লোস্টাইল করে বিলি করা যায়। বুলেটিনের খসড়া দিলাম। এক পাতার বুলেটিন সন্ধ্যের সময় শহরে ছাড়ানো হলো। হেডলাইন ছিলো “প্রথম দিনের যুদ্ধে বগুড়াবাসীর জয়লাভঃ পাঁচজন পাকসেনা নিহত”। এরপর ছিলো এক সর্বাত্মক যুদ্ধের আহবান। সবশেষে ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের নির্দেশ। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। মাটিডালিতে যখন ব্যারিকেড দিয়ে ফিরে আসিছিলাম তখন দত্তবাড়ীর সম্মুখে অয়ারলেস অফিসের একজন লোক ডাঃ জাহিদুর রহমানের হাতে একটা কাগজ দিয়ে যায়। মেসেজটি রাতে পেয়েছিলো বলে জানায়। লাল কালিতে লেখা। যতদূর মনে হয় বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়াবে? “এটি আমার নির্দেশ। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। শত্রুসৈন্য আমাদের আক্রমন করেছে। বাংলার মানুষ তোমরা যে যেখানে আছ; যার হাতে যে অস্ত্র আছে তাই নিয়ে রুখে দাড়াও। হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় না পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে”। এই নির্দেশটিও বুলেটিনে জুড়ে দিয়েছিলাম। বুলেটিন অবশ্য আমাদের তরফের ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করিনি। কারন ভেবেছিলাম তাতে সাধারণ মানুষ ভয় পেতে পারে। এর পর থেকে প্রতিদিন আমরা বুলেটিন বের করতাম। এমন কি প্রচুর গোলাবৃষ্টির মধ্যেও স্বপন ডিকটেশন নিত। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বুলেটিন সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপা হয়ে শহরে ছড়ানো হতো। ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে ১লা এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন বুলেটিন বের হতো। বুলেটিনের বিশেষ দায়িত্ব ছিলো একরামুল হক স্বপন; চন্দন ধলু এবং সৈয়দ কেরামত (গোড়া)-এর ওপর।