পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৪৪

 শুরু হলো এলোপাতাড়ি গোলাবৃষ্টি। ২৮শে মার্চে মুক্তিসেনারাও দলে বারী। মিণ্টু, ডিউক লিয়াকত (পরে রাজাকার হয়ে যায়), আব্দুর রহমান, মামুন (হক সাহেবের কম্যুনিষ্ট পার্টির), হারুন (ব্যাঙ্ক অফিসার), ধুলু বজলু, মুকুল, সাত্তার রশীদ (রশীদ গুণ্ডা নামে খ্যাত ছিলো) এবং গ্রাম থেকে প্রায় শ'খানেক বন্দুকসহ এসে যোগ দিয়েছে। প্রচণ্ড প্রতিরোধ সত্বেও ভারী মেশিনগানের গুলী এবং মর্টারের গোলাবর্ষণের আড়াল নিয়ে বেলা সাড়ে তিনটার পর পাকসেনারা ক্রল করে শহরে ঢুকতে শুরু করলো। প্রচণ্ড প্রতিরোধের মধ্যেও তা এগিয়ে চললো। বেচলা ডোবার একটু পর পাকসেনারা রেল লাইন পার হয়ে থানার মোড়ে পৌছালে। হতাশ হয়ে গেলাম এবার বগুড়ার পতন নিশ্চিতপ্রায়। জলিল বিড়ি ফ্যাক্টরীর পিছনে একটি ছোট বাড়ীতে ছাত্রলীগের সামাদ, মাসুদ, সৈয়দ কেরামত আলী গোরা আমরা কয়েকজন জড়ো হয়েছি। মাসুদকে দেখে একটি ঘটনা মনে হয়ে গেলো। ২০শে মার্চের রাতে মাসুদ এবং মুস্তাফিজুর রহমান পটল আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো স্টেডিয়ামের কাছে তাদের তৈরী বোমার কার্যকারিতা দেখাবার জন্যে। দুটি বোমা ফাটানো হলো। সে কি বিকট আওয়াজ। কিন্তু হতাশ হলো সবাই দেয়ালে একটুও চিড় পর্যন্ত ধরেনি ধ্বনি ধ্বনিসর্বস্ব বোমা।

 ঘটনা মনে আসতেই মাসুদের কাছে জানতে চাইলাম সেই বোমা আছে কিনা। সামাদ জানালো ২৩টি বোমা আছে। সামাদ এবং মাসুদ ছুটলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতবোমা দুটো নিয়ে এসে হাজির। বললাম যেমন করেই হোক দত্তবাড়ীর উত্তরে যে কোন জায়গায় রাস্তার ওপর এই বোমা দুটো ফাটাতে হবে। এবং কিছু মুক্তি সেনা কাছাকাছি জায়গায় ফাকা গুলী ছুড়বে এবং সরে পড়বে।

 শেখ ইনসান হাজী সাহেবের বাড়ীর উত্তর ধারে বোমা দুটি ফাটানো হলো। সে কী বিকট শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে এলাপাতাড়ি, কিছু একনলা দু'নলা বন্দুকের গুলীর আওয়াজ পেছন থেকে আক্রান্ত হয়েছে ভেবে সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে হানাদার সেনারা ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর দ্রুত পিছু হটে কটন মিলের গেস্ট হাউসে এবং সুবিলের উত্তর পাড়ের ঘাটিতে ফিরে গেলো। সেদিনের মতো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এক অনাড়ি মূর্খ সেনাপতির রণকৌশলে বগুড়া শহর সেদিন পতনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো।

 ২৮শে মার্চ রাতে সুবেদার আকবরে নেতৃত্বে ৩৯ জন ই;পি;আর এর একটি দল বগুড়া পৌছায়। অস্ত্র বলতে তাদের রাইফেল; কয়েকটি গ্রেনেড এবং তিনটি এল;এম;জি। বিনা খবরে ওরা পৌঁছায়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সন্দিহান হই। পুলিশ লাইনে ওদের নিরস্ত্র করে নওগাঁয় মেজর নজমুল হকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলাম। তিনি ই,পি,আরদের কাজে লাগাতে বললেন এবং ৩০শে মার্চ নিজে বগুড়া আসবেন বলে জানালেন।

 ২৯শে মার্চ। সকাল বেলায় বিস্ময়ে দেখলাম রাতে অন্ধকারে হানাদার পাক সেনা কটনমিলের গেস্ট হাউস ছেড়ে সুবিলের উত্তর পাড়ের ঘাটিতে ফিরে গেছে। নিশ্চই গুপ্তচর মারফত তারা ই,পি,আরদের পৌছানোর খবর পায়। সকাল ৯টায় সুবেদার আকবার এবং মাসুদ রেকীকরতে বের হলে। বেলা ১১টায় ইপিআর-এর কয়েকজন একটি এল,এম,জি পাকসেনাদের দিকেমুখ করে কটন মিলের ছাদে বসালেন। বেলা আনুমানিক বারোটার সময় পাক সেনারা বৃন্দাবনপাড়া প্রাইমারী স্কুলের ঘাঁটি থেকে মর্টারের আক্রমন শুরু করে। এইবার আমাদের তরফ থেকেও তিনটি এল,এম,জির মুখ দিয়ে পাল্টা জবাব গেলো, সন্ধ্যার সময়ে দুপক্ষের গোলাগুলি বন্ধ হয়। করিম হাওলাদার নামে একজন পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

 ৩০শে মার্চ। বেলা ৯টায় জেলা প্রশাসক খানে আলম সাহেব খবর পাঠালেন মেজর নজমুল হক এসেছেন। দেখা হলো মেজর নজমুল হকের সঙ্গে। মাঝারি গড়নের শ্যামল রঙের একহারা চেহারা। সর্বাঙ্গ একটা দৃঢ় প্রত্যয়ের ছাপ। সংক্ষেপে তার কাগজে সব রিপোর্ট করলাম। শেষে বললাম 'যুদ্ধ করা আমার কাজ নয়। আমি যুদ্ধের কৌশল জানিনে। আজি এসেছেন। এখন দায়িত্ব আপনার।