পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১২

ঢাকার পিলখানার কথা

সাক্ষাৎকারঃ মেজর দেলোয়ার হোসেন

১৯-১১-৭৩

 মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ২২ বেলুচকে পিলখানাতে আনা হয়েছিল। তাদেরকে এখানে থাকার জায়গা দেয়া হয়েছিল। এবং পিলখানার ইপিআর-এর সাথে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ইণ্টারনাল সিকিউরিটি ডিউটি করার জন্য ভার দেয়া হয়েছিল। ওরা ওখানে আসাতে ইপিআরদের মাঝে সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরো ঘনীভূত হয়। ওদের এখানে আসাতে আমরা বুঝতে পারলাম যে হয়তো কিছু একটা ঘটতে পারে। ক্যাপ্টেন গিয়াসের সাথেও আমার এব্যাপারে কথাবার্তা হয়েছিল।

 ২৫শে মার্চ বেলা একটার সময় মেজর জামিল (পশ্চিম পাকিস্তানী), জেনারেল স্টাফ অফিসার, হেড কোয়ার্টার ইপিআর আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠান। তিন ঘণ্টা পর্যন্ত আমি তাঁর অফিসে বসে অফিশিয়াল কথাবার্তা বলেছি। তারপর তিনি আমাকে বললেন যে, তোমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রহরী এসে আমাকে নিয়ে যায়।

 রাত আনুমানিক বারোটার দিকে চারিদিকে থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। আমি অনুমান করেছি যে, ২২ বেলুচ বাঙ্গালী ইপিআরদের উপর আক্রমণ করেছে। আমাকে ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেদিকেও গুলি এসে পড়ছিল। রাত তিন-চারটার দিকে গোলাগুলি একটু কমে যায়। আমাদের যে সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল তারা নিরাপদ জায়গায় গিয়ে গুলি ছুঁড়ছিল। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম তারা অনেককে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে। ২৬শে মার্চ ঠুসঠাস গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম।

 ২৭শে মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন আরেফ (পাঞ্জাবী), যে এই হেডকোয়ার্টারে কাজ করতো, আমাকে এসে বলল, “ইউ আর এ গাদ্দার, ইউর আংকেল ক্যাপ্টেন রফিক ইজ অলসো এ গাদ্দার। উই আর গোইং টু শট ইউ আউট বোথ।”

 ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত আমাকে এখানে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। বন্দী অবস্থায় আমাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু কোন নির্যাতন চালানো হয়নি। পরে আমাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ রাতে বহু বাঙ্গালী ইপিআরকে হত্যা করা হয়। বন্দী অবস্থাতে অনেককে হত্যা করা হয়।

 মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পিলখানার বাঙ্গালী ইপিআররা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিল প্যারেড গ্রাউণ্ডের মাঝখানে দণ্ডায়মান বটবৃক্ষের শীর্ষে। বাংলাদেশের সেনানিবাস সমূহের মধ্যে প্রথম জাতীয় পতাকা এখানে উত্তোলন করা হয়েছিল। ল্যান্স নায়েক বাশার এ পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পরে তাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। পিলখানায় অবস্থিত প্রায় ২৫০০ বাঙ্গালী সৈন্যের ৬ শতাধিক রাতের অন্ধকারে পালাতে সক্ষম হয়েছিল। বাকি সবাই বন্দী হয়। আর তাদের পাঠানো হয় নৃশংস অত্যাচার ও হত্যার বধ্যভূমি মোহাম্মদপুর বন্দী শিবিরে। পরবর্তী কালে জিসিও/এস সি ও এবং সুশিক্ষিত প্রায় ৭ শতাধিক বাঙ্গালী সৈনিককে হত্যা করা হয়েছিল বুলেট বেয়নেটের নির্মম আঘাতে। ঐ রাতে যারা পালাতে পেরেছিল তাদের অনেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। তারা প্রতি এলাকায় অমিতবিক্রমে পর্যুদস্ত করেছিল পাকিস্তানীদের প্রত্যক্ষ সম্মুখ যুদ্ধে।

 বাংলাদেশের দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই বাহিনীর ১০০০-এর মত মুল্যবান জীবন স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিল। অনেকে পঙ্গু অবস্থায় দিন যাপন করছেন।

স্বাক্ষরঃ দেলোয়ার হোসেন
১৯-১১-৭৩