পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৪৮

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ পাবনা

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৩। পাবনা জেলায় সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ গ্রন্থ ..........
১৯৭১

পাবনা শহরে পুলিশ ও জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধ[১]

 ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনী ২৫শে মার্চ তারিখে পাবনা শহরে এসে ঢুকে পড়ল। শহরের মানুষ আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল। শিগগিরই এই ধরনের একটা ঘটনা ঘটে যাবে। তারা মনে মনে এই আশঙ্কা করছিল। কিন্তু সেই ঘটনা যে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে, সেটা তারা ভাবতে পারেনি। এই তারিখেই ঢাকা শহরে আক্রমণ শুরু হয়েছিল, কিন্তু সেটা গভীর রাত্রিতে। ওরা ২৫শে মার্চ শেষ রাত্রিতে পাবনা শহরে এসে হামলা করল।

 শহর থেকে মাইল চারেক দূরে হেমায়েতপুরের কাছে ইপসিক-এর অফিস। পাক সৈন্যরা সেখানেই এসে ঘাঁটি গেড়ে বসল। তারপর সেখান থেকে কিছু সৈন্য শহরে এসে ট্রেজারী দখল করে নিল। তাছাড়া ২৭ জন সৈন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্র দখল করে বসল। তারা সারা শহরে কারফিউ জারী করে দিয়েছিল।

 হামলাকারী সৈন্যরা শহরে এসেই আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এম,এল,এ আমিনুদ্দীন সাহেব ভাসানীপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী এবং আরও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করল। যারা ওদের তাতে ধরা পড়ল, শেষ পর্যন্ত তাদের সবাইকে ওদের গুলির শিকার হয়ে মরতে হয়েছিল। এর কয়েকদিন আগেই শহরের ডি,সি ও এস,পি, স্থির করছিলেন যে শহর আক্রান্ত হলে তাঁরা প্রতিরোধ দেবেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রেরনা ও উৎসাহ পেয়ে পুলিশ ব্যারাকের ১০০ জন সশস্ত্র পুলিশও মনে মনে প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়েছিল। যতক্ষন শক্তি আছে, ততক্ষণ এই শহরকে তারা পশ্চিমাদের হাতে ছেড়ে দেবে না। যেটুকু শক্তি আছে, তাই নিয়েই ওদের বিরুদ্ধে লড়বে।

 ২৭শে মার্চ তারিখে সৈন্যরা পুলিশ ব্যারাকে যায়। এবং পুলিশদের অস্ত্রগার তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশরা এতে অসামর্থ্য জানায় এবং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে ডি,সি, তাদের অস্ত্রাগার সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন। তাঁর এই আদেশ কিছুতেই তারা অমান্য করতে পারবে না। এই নিয়ে দু’পক্ষে প্রথমে বাক-বিতণ্ডা এবং পরে গুলিবর্ষন চলে। তখন বলা শেষ হয়ে এসেছে। এই যুদ্ধে তিনজন সৈন্য মারা যায়। পাক সৈন্যরা বাহাদুর পুলিশ ভাইদের হাতে উপযুক্ত শিক্ষা পেয়ে পিছিয়ে গেল। কিন্তু এ শিক্ষাও ওদের পক্ষে যথেষ্ট হয়নি। সেই রাত্রিতে তারা নতুনভাবে আক্রমণ করবার জন্য তোড়জোড় চালাতে লাগল। রাত যখন সাড়ে চারটা তখন ওরপা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে অতর্কিতে পুলিশ ব্যারাকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু পুলিশ ভাইয়েরাও আগে থেকেই তৈরী হয়েছিল। সৈন্যরা যে আবার ফিরে এসে আক্রমন করবে সে বিষয়ে তাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না। এবার আর ব্যারাকে নয়, ব্যারাক ছেড়ে নিকটবর্তী বাড়িগুলির ছাদে এবং পথের মোড়ে মোড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আড়াল নিয়ে হামলাকারী শত্রুদের জন্য বাঘের মত ওত পেতে বসে ছিল। তারা তো ছিলই, জেলখানার পুলিশ ভাইয়েরাও তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে। এইভাবে সারাটা রাত তারা শত্রুর জন্যে মৃত্যু ফাঁদ সাজিয়ে বসে ছিল। রাত সাড়ে চারটার সময় দু’পক্ষ সংঘর্ষ ঘটল। সৈন্যদের পরিবর্তে পুলিশরাই প্রথম আক্রমণ করল। এইভাবে অতর্কিত চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে ইয়াহিয়ার সুশিক্ষিত সৈন্যরা হতভম্ব হয়ে গেল। এই সংঘর্ষ ২১ জন সৈন্য নিহত হবার পর বাকী সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণ নিয়ে পালাল। পুলিশদের মধ্যে একজনও মারা যায়নি। সাবাস! পাবনার পুলিশ ভাইয়েরা।

  1. ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে ‘পাবনার মুক্তিযোদ্ধা’ শীর্ষক অংশ থেকে সংকলিত।