পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



৩৫২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

শুনলাম (গ্রামের নাম মনে নেই)। এসডিও শামসুদ্দিন সাহেবের কমাণ্ডে আমরা ১০০ জন তিন ভাগে ভাগ হয়ে পাক ঘাঁটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিই। একদল আক্রমণ চালাবে, একদল গাড়ী ধ্বংস করবে এবং একদল ব্রিজ ধ্বংস করবে একই সময়ে। আমরা আক্রমন করি রাত ২টার দিকে। একই সাথে ব্রিজ ধ্বংস, ৫টি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১৯ জন পাকসেনা খতম হয়েছে শুনলাম। পরদিন ভোর বেলা আমরা ফিরে আসি। আমাদের একজন ইপিআর জোয়ান গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। তাকে সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই।

 এপ্রিল মাসের ২৫তারিখের দিকে এসডিও সাহেব ফিরে আসলেন বাঘাবাড়ী ঘাট থেকে। তিনি আবার গেলেন বাঘাবাড়ী ঘাটে। আমিও গেলাম এসডিও সাহেবের সাথে। তার পরদিন পাকবাহিনী দুপুর ১টার দিকে হঠাৎ করে কাশীনাথপুর ক্যাম্প আক্রমণ করে। একজন হাবিলদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ক্যাম্পের। আমাদের জোয়ানরা বিশ্রাম করছিলো, ঠিক এসই সময় শত্ররা মর্টার আক্রমণ চালায় চারদিক থেকে। ৩০/৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা ওখানে শহীদ হয় বাকিরা পালিয়ে যায় অস্ত্র ফেলে। পাকসেনারা আমাদের প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে। আমি ১৫ জন উদ্ধার কর্মী নিয়ে পরদিন চারদিকে খুঁজতে লাগলাম আমাদের বাহিনীর লোকদের। ২ জন আহত বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ৮/১০ জন অন্যান্য জোয়ান নিয়ে বাঘাবাড়ী ঘাটে চলে আসি। আমাদের ডিফেন্স আরও জোরদার করি।

 মে মাসের প্রথম সপ্তাহে লতিফ মীর্জাকে বাঘাবাড়ী ঘাটের দায়িত্ব দিয়ে আমি এবং এসডিও সাহেব অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতে যাই। সিদ্ধান্ত হয় ৪ কোটি টাকার অস্ত্র কেনা হবে। পশ্চিম দিনাজপুরে ভারতীয় কর্নেলের সাথে দেখা করেন আমাদের এসডিও সাহেব। যাবার পথে হিলি সীমান্তে ক্যাপ্টেন আনোয়ার আমাদেরকে খুব বেশী অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে পাবেন না জানান। তারপরই আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দিনাজপুর যাই। এসডিও সাহেব অস্ত্র কিনতে চান। কর্নেল সাহেব জানান, এভাবে অস্ত্র বিক্রী করা যায় না। এসডিও সাহেবের না-খাওয়া, না ম্নান অবস্থা অহোরাত্র চিন্তায় মাথা প্রায় খারাপ ছিল। তাই কর্নেল সাহেব অস্বীকার করলে এসডিও সাহেব খুব রাগারগি করেন। বাকবিতণ্ডা হয়। কর্নেল সাহেব পাক স্পাই মনে করে আমাদের দু’জনকে বন্দী করেন। আমি কোনরকমে খবর পাঠিয়ে কংগ্রেসনেতা এবং ছাত্রনেতার কাছে আমাদের অবস্থা জানাই। ছাত্রনেতা এবং কংগ্রেস এমপিদের প্রচেষ্টায় আমরা মুক্তি পাই। তারপর ফিরে আসি বাঘাবাড়ী ঘাটে।

ফিরে শুনলাম সিরাজগঞ্জ বাঙ্গালী-বিহারী মারামারি হয়েছে। বিহারীদের নিরাপত্তার জন্য এসডিও সাহেব সকল বিহারীকে গ্রেফতার করে জেলখানাতে নিয়ে আসেন। এসডিও সাহেব ও আমি বাঘাবাড়ী ঘাটে ফিরে যাই আবার।

মে মাসের ২০তারিখের দিকে বাঘাবাড়ী নদীর অপর পারে পাক বাহিনী বাংকার করা শুরু করে। আমরা আক্রমন করি। ক্রমাগত চারদিন পর তারা বিমান হামলা চালায় আমাদের উপর।

২৩/২৪ তারিখের দিকে আমরা পিছু হটে উল্লাপাড়া চলে আসি। আমরা প্রায় ১৫০ জন ছিলাম তখন। বাকি বাহিনীকে সিরাজগঞ্জে পাঠানো হয়। আমরা মোট প্রায় ৪০০ জন ছিলাম।

আমরা উল্লাপাড়া থেকে ২/৩ দিন রাতে অকস্মাৎ বাঘাবাড়ী ঘাটে পাক বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে পালিয়ে যেতাম।

ঘটনা প্রতিরোধঃ মে’র ২৫ তারিখে পাক বাহিনী উল্লাপাড়া আক্রমণ করলে আমরা ঘটনা (সলপ) ব্রিজে আসি। আমরা সলপ স্কুলে আশ্রয় নিই। এসডিও সাহেব এবং লতিফ মীর্জা আমাদের সাথে। ওখান থেকে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোকেরা বলে, “আমরা শেষ পর্যন্ত মারা যাবো, শেষবারের মত স্ত্রী- ছেলেমেয়েদের দেখতে দিন৷” এসডিও সাহেব প্রত্যেককে ২০০/৩০০/১০০ টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের নায়েক মহিউদ্দীন আমাদের ছেড়ে গেলেন না।