পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৫৬

উঠেছিল তাঁর সেই বলিষ্ঠ সংগ্রামী ভূমিকায়। সবাই তাঁকে ভূষিত করেছিল কর্নেল উপাধিতে। সবাই তাঁকে ডাকতো কর্নেল শামসুদ্দিন বলে। নাম ছিল তাঁর এ, কে, শামসুদ্দিন।

 শামসুদ্দিন তখন ছিলেন সিরাজগঞ্জের এসডিও। গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার মিথ্যা প্রলোভনে এদেশের মানুষকে মাসের পর মাস সন্দিগ্ধ রেখে সেই পঁচিশে মার্চের যে ভয়াল রাতে পাকিস্তানী হানাদাররা তাদের হিংস্র বিষাক্ত থাবা মেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গ্রামবাংলার সাড় সাত কোটি মানুষের ওপর, সেই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দিনে এদেশের অসহায় মানুষের পক্ষে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম যারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন জনাব শামসুদ্দিন তাদের অন্যতম।

 শুধু রুখে দাঁড়িয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি-তিনি রীতিমত গড়ে তুলেছিলেন এক বিরাট সংগঠন। সামান্য মাত্র অস্ত্র সম্বল করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সম্মুখযুদ্ধে। বাংকারে বাংকারে নিপুণ যোদ্ধার মত অস্ত্র হাতে নিয়ে চালিয়েছিলেন লড়াই, শত্রুর সাথে মোকাবিলায় দেখিয়েছেন চমৎকার নৈপুণ্য, দিখিয়েছেন পারদর্শিতা।

 বাঘাবাড়ীর প্রতিরোধঃ শত্রুবাহিনীর অগ্রাভিযানের বিরুদ্ধে বাঘাবাড়ীতে যে প্রচণ্ড প্রতিরোধ তিনি গড়ে তুলেছিলেন তা এক অস্মিরনীয় ঘটনা। হানাদাররা ৯ই এপ্রিল নদী পার হয়ে চারদিকে যখন হত্যা ও ধ্বংসের হাহাকার তুলে এগিয়ে চলছিল উত্তরবঙ্গের শহর-বন্দরের দিকে তখন এই বাঘাবাড়ীতেই তাদেরকে বাধা দেন জনাব শামসুদ্দিন তাঁর সামান্য সামর্থ্য, সামান্য শক্তি নিয়ে। একদিন দুইদিন এভাবে একটানা পাঁচদিন তিনি এই প্রতিরোধ এড়াবার জন্য হানাদার বাহিনী গতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল।

 সোজা পথে সিরাজগঞ্জে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে তারা শুরু করেছিল বোমাবর্ষণ। ২৬মে এপ্রিল সিরাজগঞ্জবাসীদের ওপর নেমে আসে হানাদারদের এই বর্বর অভিশাপ। আর এই বিমান হামলারই আবরণে সুযোগ বুঝে ২৭মে এপ্রিল তারা ঢুকে পড়ে শহরে।

 জনাব শামসুদ্দিন এই সময়ে চলে যান চর এলাকায়। চর এলাকার অধিবাসীদের নিয়েই তিনি চেষ্টা করতে থাকেন একটি সশস্ত্র দল গঠনের। চেষ্টা করতে থাকেন অস্ত্র সংগ্রহের। এই অস্ত্র সংগ্রহের জন্যেই তিনি ঘুরতে থাকেন এখানে-ওখানে। তিনি যান টাঙ্গাইলে। যোগাযোগ স্থাপন করেন সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে।

 আর এই ঘোরাঘুরিই তাঁর কাল হোল। সর্বনাশা মৃত্যু যেন দুই ব্যাগ্র হাত মেলে বসেছিল তাঁকে ছিনিয়ে নিবার জন্য। আর সেই কঠিন মৃত্যুর হাতে নিজেকে সঁপে দেবার জন্যেই বুঝি তিনি ঢাকায় এসেছিলেন মে মাসের গোড়ার দিকে। এসেছিলেন তিনি গোপনে। এসেছিলেন কর্তব্যের ডাকে। এ কর্তব্য ছিল তার পরিবারের।

 কিন্তু গোপনে এলেও গোপন তিনি থাকতে পারেননি। ১৭ই মে তিনি ধরা পড়ে যান খানসেনাদের হাতে। তার পরের ইতিহাস বর্বর খানসেনাদের নারকীয় নির্যাতনের ইতিহাস। তার পরের ইতিহাস ক্যাণ্টনমেণ্টের একটি ছোট্ট সেলে অমানুষিক নির্যাতনে তাঁর মৃত্যুবরণের ইতিহাস। বাঘাবাড়ী-সিরাজগঞ্জে যিনি ছিলেন খানসেনাদের ত্রাস সেই প্রতিভাধর তরুণ বাঙ্গালী অফিসারকে হাতের মুঠোয় পেয়ে বুঝি উল্লাসে নেচে উঠেছিল হানাদারদের চোখ।

 অত্যাচার-নিয়াতনে অর্ধমৃত জনাব শামুদ্দিনের ওপর শেষবারের মতই তাদের আক্রোশ মিটিয়ে নেবার জন্যেই বোধ হয় ২৯শে মে বিকেলে সেলের ভেতরে তার ওপর লেলিয়ে দেয়া হয়েছেল মেজর সরফরাজের জল্লাদ দল-ক্র্যাক পার্টিকে। নিষ্ঠুর এক পৈশাচিকতা নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জনাব শামসুদ্দিনের ওপর। মৃত্যুপথযাত্রী এই অসহায় মানবসন্তানের ওপর তারা তাদের আক্রোশ মিটিয়েছিল সর্বশক্তি দিয়ে।

 এ অত্যাচার আর তিনি সইতে পারেননি। মৃত্যুর প্রান্তে পৌছে সেলের মধ্যে তাঁরই সাথে আটক সিলেটের এক ভদ্রলোকের কোলে মাথা রেখে তিনি খেতে চেয়েছিলেন এক ফোঁটা পানি।