পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৬২

খবর পেলাম। রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই পাকসেনা আসার আগেই আমরা সমগ্র প্রশাসনযন্ত্র তথা অস্ত্র আমাদের হাতে নিয়ে আসবে।

 মার্চ মাসের শুরু থেকেই আমিসহ আমার দলের লোকজন বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে জনমত গঠন করে। পাক-আক্রমণ ঘটলে যেকোন জবাবের জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। সমগ্র বরিশাল জেলার বিভিন্ন থানা, উইনিয়ন, গ্রামে সভা করে বেড়াই। মানুষ প্রস্তুত ছিল যেকোন অবস্থার জন্য।

 ২৬শে মার্চ আমি এবং নূরুল ইসলাম মঞ্জুর মিলে পুলিশ লাইনে পুলিম রিজার্ভ ফোর্সের সামনে বক্তৃতা করি। তারা সবাই হাত উঠিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত বলে জানায়। এস-পি'র সাথে আলাপ-আলোচনা করি। আমরা সমস্ত জেলার দায়িত্ব নিই। পাকসেনা ওয়াপদা কলোনীতে কিছু ছিল, তারা আমাদের ফোন পেয়ে পালিয়ে যায়।

 ২৭শে মার্চ আমরা এসপি'র কাছে থেকে চাবি নিয়ে ট্রাকে করে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যাই। লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী কাশীপুর, মঞ্জুর সাহেবের বাসাতে অস্ত্রশস্ত্র রাখি এবং ছাত্র, পুলিশ, আনসার, সাধারণ লোক, ছাত্রলীগ কর্মী, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, শ্রমিক সব মিলে ৪/৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা তৈরী করি। ২৭/২৮শে মার্চ থেকে পুলিশ লাইনে এবং বেলস পার্কে (বঙ্গবন্ধু পার্ক) আর্মস ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। উজিরপুর থানাতে মেজর জলিলের বাড়ী। জনসভা করে বের হওয়ার সময় মেজর জলিলের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। সে আমাদের বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে বলে, “আমি ছুটিতে আছি, যদি কোন কাজে লাগে ডাকবেন।” ২৮শে মার্চ আমরা চিঠি পাঠিয়ে মেজর জলিলকে নিয়ে আসি এবং কাজে লাগাই। আমরা ডিসির বাংলোতে আলাপ-আলোচনা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এম-পি-সিভিল প্রধান; মহিউদ্দীন আহমদ এম-পি খাদ্য এবং যোগাযোগ; আমির হোসেন আমু, এম-পি-সাহায্য; আমিনুল হক চৌধুরী-বিচার বিভাগ; এম-পি সার্জেণ্ট ফজলুল হক, মেজর জলিল ও এস-পি-ডিফেন্স; আবদুল মালেক খান, আওয়ামী লীগ সভাপতি-অর্থ বিভাগ; সর্দার জালাল, এডভোকেট ইউসুফ, হুমায়ুন এমপি-প্রচার বিভাগ; কাজী মহিউদ্দিন-নদীপথ যোগাযোগ; হেমায়েত উদ্দীন এডভোকেট-সমন্বয় বিভাগ। প্রত্যক বিভাগের সাথে ডিসি, এসপি, এডিসি, যাবতীয় বিভাগীয় প্রধানরা সম্পাদক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ডিসি ছিলেন হাবিবুর রহমান, এমপি ফখরুদ্দিন আহমেদ, এডিসি কাজী আজিজুল ইসলাম (শহীদ), অতিরিক্ত জেলা পুলিশ প্রধান গোলাম আহমদ (শহীদ), জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আসমত আলী, আনসার এ্যাডজুটেণ্টরাও আমাদের সহযোগী ছিলেন। তালতলী, সাগরদি, কাশীপুর এলাকা, লাকুটিয়া ইত্যাদি স্থানে ডিফেন্স দেওয়া হয়। শহরের ভিতরেও আমাদের গোপন সেল ছিল।

 ইতিমধ্যে ঢাকা, খুলনার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার শরণার্থী তথা আহত লোক আসা শুরু করে। তাদেরকে কলেজসহ বিভিন্নস্থানে রাখার ব্যবস্থা করি এবং পরে তাদেরকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা আমি নিজে করি। ফোন মারফত আমাদের বাগেরহাট, ফরিদপুর, মাদারীপুর, পটুয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর ইত্যাদি স্থানের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল।

 এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মঞ্জুর সাহেব (এমপি) আগরতলা যান। তিনি আগরতলা থেকে ফিরে আবার কলকাতা যান অস্ত্রের জন্য। তাঁর অনুপস্থিতিতে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে ডিফেন্সের। আমি ১৫০ জনের মত যোদ্ধাকে অস্ত্র, খাদ্য, ওষুধ সহ লঞ্চযোগে চাঁদপুর পৌঁছি মিজানুর রহমান চৌধুরীর অনুরোধে। এই বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস আক্রমণ করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। আমাদের বাহনীর ৩০ জনের মত শহীদ হয় ওখানে।

 বাগেরহাটেও আমরা পাঠিয়েছিলাম ৬০ জনের মত যোদ্ধাকে। খুলনার যুদ্ধে আমাদের ৩/৪ জন শহীদ হন। আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি ছিল যারা মোটরসাকেল এবং মোটর সহযোগে যোগাযোগ রাখতো। প্রতি থানাতে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। থানার সাথে আমাদের সব সময় যোগাযোগ থাকতো। বরিশালের সকল মহকুমায় আমরা নির্দেশ এবং যোগাযোগ রাখতাম।