পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৬৩

 ২৬শে এপ্রিল বরিশালের পতন ঘটে পাক বহিনীর হাতে। ইতিমধ্যে এপ্রিল মাসের ১০/১২ তারিখে এবং ১৯/২০ তারিখে পাক বিমান দু'বার হামলা চালিয়ে আমাদের একটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেয় এবং বোমার আঘাতে ২০ জনের মত লোক মারা যায়। বহু আহত হয়। পথিমধ্যেও বহু লোক মারার যায়। মঞ্জুর সাহেবের কথা মত মেজর জলিল এবং ক্যাপ্টেন হুদাকে অস্ত্রের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। মঞ্জুর ভাই ইতিমধ্যে ২২ এপ্রিল কিছু অস্ত্র নিয়ে বরিশাল আসেন।

 ২৫শে এপ্রিল ভোরবেলা থেকে পাকসেনারা শেলিং করতে করতে আসে মুলাদির দিক থেকে। খুলনার দিক থেকেও আসতে থাকে। ফরিদপুর থেকেও স্থলবাহিনী মার্চ করে আসতে থাকে। ৪টি জেট অনবরত বোমা ফেলা শুরু করে। পর মুহুর্তে ৬টি হেলিকপ্টারযোগে অসংখ্য ছত্রীসেনা নামিয়ে দেয়। মঞ্জুর তখন তালতলী (উত্তর দিকে) ও আমি দক্ষিণ দিকে যুদ্ধ পরিচালনা করি। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন ফিরুর গুলি লাগে। পাশাপাশি মঞ্জুরও ছিল। মঞ্জুর আমাকে মেসেজ দেন ফোর্স নিয়ে লাকুটিয়া রওয়ানা হবার জন্য। আমি নিজে বাহিনীর ডাক্তারসহ লাকুটিয়া রওনা হই। কিন্তু অনবরত বোমা ফেলার জন্য লাকুটিয়া না যেতে পেরে সরদার জালাল, আমিনুল হক চৌধুরী এবং কিছু ছেলে নিয়ে কাশীপুর ক্যাম্পে চলে যাই। এর আগেই অবস্থা বুঝতে পেরে শহর থেকে বেসামরিক লোকদের সরে যেতে বলি। আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকেও চলে যেতে বলি। সরদার জালালকে রুহাতে (গ্রাম) রেখে একটি জীপ নিয়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধাসহ বিকাল ৫টার দিকে শহরে চলে আসি অবস্থা দেখার জন্য। শহরে ঢোকার সময় গ্রামসংলগ্ন রাস্তার দু'পাশে বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধাকে পজিশন নিয়ে থাকতে দেখি। আমি কিছু মুক্তিবাহিনীকে নদীর ওপারে (কীর্তনখোলার ওপারে পজিশন নিয়ে গানবোটে সুযোগ বুঝে আক্রমণ করতে বলি।

 শহর তখন শূন্য। কিছুক্ষণ পরপরই আবার ব্যাপকভাবে বোমা ফেলা শুরু হয়। আমি ও ড্রাইভার দু'জন বাংকারে আধ ঘণ্টা বসে থাকি। বোমা ফেলা একটু কমলে গাড়ী নিয়ে রুহা গ্রামে রওনা হই। ছত্রীসেনা নেমে গিয়েছিল। তারা আমার গাড়ী লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আমরা অল্পের জন্য বেঁচে যাই। রুহা গ্রামে পৌঁছালে মঞ্জুরের মেসেজ পেলাম যে আমাদের লাকুটিয়া ঘাঁটির পতন ঘটেছে। তিনি স্বরূপকাঠির দিকে যোদ্ধা নিয়ে রওনা হয়েছেন। আমাকে রাতেই তার সাথে দেখা করতে বলেন। রাতেই কিছু যোদ্ধা, জালাল আহমেদসহ রওনা হয়ে পরদিন ভোরবেলা স্বরুপকাঠি (থানা) গিয়ে পৌঁছাই। ২৬ তারিখে রাত ৩টার দিকে কাউখালীতে মঞ্জুরের সাথ আলাপ করি। আমরা ওখান থেকে গানবোটের শেলিং শুনতে পাচ্ছিলাম।

 ২৭শে এপ্রিল রওনা হয়ে আমরা ৩টি বড় লঞ্চে বহু পরিবারসহ (২০০/৩০০) সুন্দরবন হয়ে হাসনাবাদ পৌঁছাই ২৯শে এপ্রিল। বিশ্রাম সিংহ তখন সীমান্ত রক্ষী বাহিনী প্রধান ছিলেন। তিনি আমাদের সাদরে গ্রহণ করেন। কলকাতার বালিগঞ্জে মঞ্জুরসহ মন্ত্রী পরিষদের সাথে দেখা করে আলাপ-আলোচনা করি বরিশালের সব কথা বলি। জেনারেল ওসমানীর সাথেও ওখানে সাক্ষাৎ হয়। বিশ্রাম সিংহ মিঃ মুখার্জী, নেভাল কমাণ্ডার কে,বি, সিংহ- এদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। এদের আন্তরিকতা ও সাহায্য-সহানুভূতি ভোলা যায় না।

 ১লা মে থেকে ৭ই মে পর্যন্ত হাসনাবাদ, ব্যারাকপুর পাগলের মত আমি এবং মঞ্জুর ঘোরাঘুরি করে দুই লঞ্চ আধুনিক অস্ত্র, ওষুধ, ড্রাই ফুডসহ কয়েক লক্ষ টাকার জিনিস সরকারী চুক্তি ছাড়াই কামাণ্ডার মুখার্জী, কে,বি, সিংহ, বিশ্রাম সিংহ গোপনে আমাদের হাতে তুলে দেন। ৬/৭ দিন আমাদের ছেলেদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে প্রতি গ্রুপকে বিভিন্ন অস্ত্রে বিশেষ শিক্ষা দিই। আমরা নিজেরাও শিক্ষা নিই। আমি, মঞ্জুর, সরদার জালাল, প্রায় ৮০ জন যোদ্ধা, মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন রহমান, লেঃ নাসের সহ ২টি লঞ্চ ভর্তি অস্ত্র ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে বরিশালের দিকে রওনা হই। ৪০ হর্স পাওয়ারের স্পীডবোটও ছিল আমাদের সাথে।

 দুপুর ২টার দিকে আমরা হাসনাবাদ থেকে রওনা হই। ২টি ভারতীয় নেভাল শীপ আমাদের পৌঁছে দিয়ে সালাম করে চলে য়ায়। একটি লঞ্চে মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন রহমান এবং অন্যটিতে আমি, মঞ্জুর, লেঃ ময়নুল ছিলাম। আমরা সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করি।