পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৪

অনন্যোপায় হয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকি। অল্প সংখ্যক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাকি সবাই বন্দী হয়ে যায়। রাত ৪টার সময় আমাদেরকে আত্মসমর্পণ করায়।

 ৩ নং গেটে কর্তব্যরত কয়েকজন বাঙ্গালী ইপিআর পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। একজন লেফটেন্যাণ্ট সহ ৬ জন পশ্চিম পাকিস্তানী বেলুচ রেজিমেণ্টের লোক নিহত হয়। এই খণ্ড যুদ্ধে বাঙ্গালীদের সঙ্গে কর্তব্যরত একজন পাঞ্জাবী ইপিআর মোহাম্মদ খানকেও হত্যা করা হয়। এই খণ্ড যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল গার্ড কমাণ্ডার নায়েক জহিরুল হক। সে তার সহকর্মীদের নিয়ে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ঢাকায় অবস্থিত সিগনাল- এর প্রধান বেতার কেন্দ্রে খবর পৌঁছে দেয়া হয় যে, উইং কমাণ্ডার লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেল আবদুর রহমান আওয়ান আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছে সমস্ত বেতার যোগাযোগ বন্ধ রাখার জন্য। আমাদের কর্তব্যরত অপারেটররা সংকেতের সাহায্যে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বাইরে কর্তব্যরত সেক্টর/উইং/বিওপি পর্যন্ত সমস্ত ইপিআরকে জানিয়ে দেন। ২৬ শে মার্চ সকাল দশটা পর্যন্ত আমাদের এইচ-এফ (হাই ফ্রিকোয়েন্সি সেট) চালু থাকে যার মাধ্যমে ২৬শে মার্চের ঘটনা নায়েক শহীদ বাশার বাইরের সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার শেষ সংবাদে চট্টগ্রামকে বলেছিলেন যে, আমাদের সবাই বন্দী হয়ে গেছে। হয়তো কিছুক্ষণ পর আমিও বন্দী হয়ে যাব এবং আর নির্দেশ দেবার সময় পাবনা। তোমরা সমস্ত পশ্চিমাদের খতম কর। চট্টগ্রাম থেকে হাবিলদার বাহার উক্ত সংবাদ সীমান্তের চৌকি পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এবং আমাদের লোকজনকে অনুপ্রাণিত করার জন্য সে বলেছে যে, আমি ঢাকা থেকে বলছি। সম্পূর্ণ ঢাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন চলে এসেছে এবং ইপিআর- এর ডাইরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার নেসার আহমদ বন্দী হয়েছেন। তোমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়। এবং সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানীদের বন্দী করে আমাকে রিপোর্ট দাও।

প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ বাহিনী

সাক্ষাৎকারঃ মোঃ আসমত আলী আকন্দ[১]

এস, আই অব পুলিশ, রমনা থানা, ঢাকা

১০-১-৭৪

 ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় আমি রাজারবাগ রিজার্ভ অফিসে কাজ করছিলাম। আমাদের রিজার্ভ অফিসের বাইরে সহস্র বিক্ষুব্ধ জনতা বড় বড় গাছ ও ইট পাটকেল দিয়ে ব্যারিকেড তৈরী করেছিলো। সন্ধ্যার সময় এ সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, পাক হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশের রিজার্ভ অফিস আক্রমণ করবে। এ সংবাদ শোনার পর আমি রাত সাড়ে ন’টার সময় তেজগাঁও থানায় কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাকে ঢাকা সেনানিবাসে পাক হানাদারদের মনোভাব কি তা জানাবার জন্য টেলিফোনে অনুরোধ করি। তিনিও পাক হানাদার কর্তৃক রাজারবাগ রিজার্ভ অফিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবানার কথা শুনেছেন বলে জানান। এরপর আমি তেজগাঁও আবার টেলিফোন করে জানতে পারি যে তখন পাক হানাদারদের প্রায় ৮০/৯০টি সশস্ত্র ট্রাক ও জীপ তাদের থানার রাস্তা ধরে রাজধানীতে প্রবেশ করতে তারা দেখেছেন। রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের ওপর পাক হানাদারদের এমন উলঙ্গ হামলার সংবাদ শুনে আমাদের আরআই একেবারে হতবাক হয়ে যান। এরপর আমরা পুলিশ রিজার্ভের অস্ত্রাগার থেকে প্রয়োজন মতো অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত প্রতিরোধ এবং প্রতিহত করার জন্য রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ অফিসের চারিদিকে পজিশন নিয়ে শত্রুর অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিয়ে সমস্ত পরিবেশ একেবারে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলি। আমরা বাইরে অনেক দূর থেকে পাক হানাদারদের বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণের শব্দ শুনছিলাম। আমরা শুধু পজিশন নিয়ে শত্রুর অপেক্ষা করছিলাম। অয়ারলেস ও টেলিফোনের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।


  1. ১৯৭১ সালের পূর্বে রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ অফিসের প্রোসিডিং সেকশনে এ-এস-আই হিসাবে কর্মরত ছিলেন।