পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৬৫

গিয়েছিলেন। মেজর জলিল তখন বাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। এর আগে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ভারতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন। তিনিও স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছিলেন।

 লাকুটিয়াতে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে আমরা সেখান থেকে মাধবপাশা চলে গেলাম। আমরা প্রায় ৩০ জন লোক ছিলাম। তাদের মধ্যে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, লেঃ নাসিরও ছিলেন। মাধবপাশা থেকে আমরা মামুদকাঠিতে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেলাম। এখানে আমরা শপথ গ্রহণ করি যে, আমরা সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব। এখানে বসে আমরা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করি। দুটো ছেলেকে খবর আনার জন্য বরিশাল শহরে পাঠানো হয়।

 আমরা পুলিশের এস-পি'র লঞ্চে করে সুন্দরবনের দিকে রওনা হলাম। ২৭শে এপ্রিল দুপুরের দিকে সুন্দরবনে ঢুকলাম। ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত সুন্দরবনের মধ্যে ছিলাম। সুন্দরবন, শরণখোলা, বুড়িগোয়ালিনী হয়ে ১লা মে ভারতীয় সীমান্ত হিংগলগঞ্জে পৌঁছালাম। সেদিনই ভারতের হাসাবাদে চলে গেলাম কালিন্দী নদীর মধ্য দিয়ে।

 এখানে এসে মেজর জলিল, লেঃ হুদা এবং আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা হয়। বরিশাল শহরের পতনের ৪/৫ দিন পূর্বে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তাঁরা ভারতে গিয়েছিলেন। তারা ভারতের কাছ থেকে বেশ অস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেখানে দিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, এ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুন্দরবনের কোন এক জায়গায় ঘাঁটি স্থাপন করা হবে।

 ৬ই মে দুটো লঞ্চে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করা হল। আহত কামাল এবং লেঃ হুদাকে হাসনাবাদে আরো অস্ত্র সংগ্রহের জন্য রেখে আসা হল। আমরা দুপুরের দিকে রওনা হলাম। আমরা হিংগলগঞ্জে এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সন্ধ্যার দিকে কৈখালীর সীমান্ত ঘাঁটির কাছে একটা খালের মধ্য দিয়ে ঢুকে পড়লাম। আমাদের বড় লঞ্চটা আগে ছিল এবং মেজর জলিলের লঞ্চটা ২৫/৩০ গজ পিছনে ছিল। লঞ্চ-এর সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছিল। বড় লঞ্চে আমি, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এমপি মহিউদ্দিন, সেকেণ্ড লেঃ নাসির এবং আরো অনেকে ছিল। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল এবং বৃষ্টি হচ্ছিল। বুড়িগোয়ালিনীর কাছে কপোতাক্ষ নদীতে পাকিস্তানীদের দুটো গানবোট ছিল। আমরা গানবোটগুলো প্রায় ৫০ গজের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। তখন গানবোট থেকে আমাদের লঞ্চের উপর সার্চলাইট ফেলা হল এবং ১টা সিগন্যাল ফায়ারও করা হল। লঞ্চটাকে নদীর পারে লাগিয়ে আমরা ছোট-খাট অস্ত্র এবং কিছু গুলির বাক্স নিয়ে নদীর পাড়ে লাফিয়ে পড়লাম। পিছনের লঞ্চ থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। তখন গানবোটগুলো আমাদের উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। আমরা বাঁধের অপরদিকে গিয়ে বসে পড়লাম। এখান থেকে আমরা কিছুক্ষণ গুলিবর্ষণ করি এবং পেছনের লঞ্চের কাছে যাবার চেষ্টা করি। রাত তিনটা পর্যন্ত গানবোটের সাথে আমাদের গোলাগুলি বিনিময় হয়। আমরা লঞ্চ থেকে নামার ঘণ্টাখানেক পরে লঞ্চে আগুন ধরে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়ে যায়।

 আমরা ১৪/১৫ জন পেছনের লঞ্চের দিকে এগুতে লাগলাম, কিছুদূর গিয়ে আমি এবং আর একজন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র মইনুল পথ হারিয়ে ফেলি। পথ হারিয়ে আমরা আবার পেছনের দিকে যেতে শুরু করি। কিছুদূর গিয়ে একটা ডিংগী নৌকা দেখতে পেলাম। আমরা নৌকায় উঠলাম। কিন্তু নদীর মধ্যে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের উপর গানবোট থেকে সার্চলাইটের আলো এসে পড়ল। আমরা নদীতে লাফিয়ে পড়লাম এবং সাঁতরে নদীর অপর পাড়ে পৌঁছলাম। সেখান থেকে একজন লোকের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। তখন ভোর হয়ে গিয়েছিল। সে এলাকাটি ছিল মুসলিম লীগের সমর্থকদের। পথে আমরা কয়েকবার মুসলিম লীগের দালালদের হাতে ধরা পড়েছি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। অবশেষে আমরা আবার ভারতে চলে যেতে সমর্থ হই।