পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৬৭

কটকস্থল গ্রামের যুদ্ধের দিন কয়েক পরে। গৌরনদী পাক-সৈন্যদের দখলে এসে গিয়েছে। এখানকার ঘাঁটি সুদৃঢ় করে নিয়ে এবার তারা বরিশাল শহর দখলের অভিযানের জন্য তৈরী হচ্ছে। অপর দিকে বরিশাল শহরে মুক্তিবাহিনীও চুপ করে বসে নেই। হামলাকারী শত্রুদের প্রতিরোধ করবার জন্য তারা তাদের পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করে চলেছিল।

 বরিশাল শহরের মুক্তিবাহিনী গৌরনদীর মুক্তিবাহিনীর তুলনায় অনেক বেশী শক্তিলালী। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ও অস্ত্রবলের দিক দিয়েই নয়, তাদের মধ্যে যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ লোকও ছিল। ছাত্র ছাড়াও বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ইপিআর বাহিনীর জওয়ানরা, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি নিয়ে এই বাহিনী গড়ে উঠেছিল।

 মুক্তিবাহিনীর নেতারা প্রতিরোধ-প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে এসে এক নতুন রণকৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন। এই কৃতিত্বের জন্য অবশ্যই তাদের প্রশংসা করতে হবে। সি-এণ্ড-বি রোড বরিশাল শহরকে ফরিদপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে। শত্রুরা এই পথ দিয়েই বরিশাল শহর আক্রমণ করতে আসবে। তাদের গতিপথকে রুদ্ধ করে দেবার জন্য এবং তাদের অচল করে ফেলবার জন্য ইতিপূর্বে এই সড়কের বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর নির্দেশে সেই সমস্ত গ্রামের লোকেরা উদ্যোগী হয়ে সেই কাজে হাত দিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনী শেষ মুহূর্তে হঠাৎ তাদের এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়ে এক নতুন রণকৌশল নিয়ে শত্রুপক্ষের জন্য এক মায়ার ফাঁদ পেতে বসল। দেখতে দেখতে সমস্ত ব্যারিকেডগুলিকে সরিয়ে নিয়ে এই রাস্তাকে যানবাহন চলবার পক্ষে সুগম করে দেওয়া হোল। শত্রুরা যাতে বিনা বাধায় এবং নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসতে পারে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

 বরিশাল শহলে আসতে হলে পর পর দুটো নদী পেরিয়ে আসতে হয়। প্রথমটা শিকারপুরের নদী, দ্বিতীয়টা দোহারিকা নদী। এই দুয়ের মাঝখানে দশ মাইল স্থলপথ। এইখানে মায়ার ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। পথে কোথাও কোন বাধা পাওয়া যাবে না, কোন ব্যারিকেড সরিয়ে আসতে হবে না, কোন ভেঙ্গে ফেলা পুল সারাই করে নিতে হবে না এমন কথা পাক-সৈন্যরা ভাবতেও পারেনি। এমন সহজ সুগম পথ পেয়ে তাঁরা মহাখুশী। তাদের সৈন্যবাহী গাড়িগুলি স্বচ্ছন্দে শিকারপুরের নদীর পার পর্যন্ত চলে এল।

 ফেরী বোটে করে এই নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে যেতে হবে। ওরা উল্লাসিত হয়ে দেখল ফেরীবোটের মাথায় পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। ফেরীবোটের লোকেরা ওদের আসতে দেখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলে জয়ধ্বনি তুলল। তখনকার মত দুর্দিনে এমন সাদর সংবর্ধনা পাবে, এটা ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। আনন্দে ডগমগ হয়ে ওরা ফেরীবোটের সাহায্যে নদী পার হতে লাগল। মুহূর্তের জন্য তাদের মনে এই সন্দেহ জাগেনি যে, এই ফেরী বোট যারা চালিয়ে যাচ্ছে, তারা সবাই মুক্তিবাহিনীর লোক; মুহূর্তের জন্যও তারা ভাবতে পারেনি যে তারা ইতিমধ্যেই প্রতিপক্ষের রচিত মায়ার ফাঁদে পা দিয়ে বসেছে।

 এমনি করে ক্রমে ক্রমে নববই জন সৈন্য আর চালকসহ ন'খানা গাড়ি পারি দিয়ে ওপারে গিয়ে উঠল। এখানেও কোন বাধা নেই, ওরা স্বচ্ছন্দে এগিয়ে চলল। একটু দূরে গিয়েই ওরা থামল। তাদের গোয়েন্দারা চারদিকটা ভাল করে পরীক্ষা কারে দেখে নিল-না, কোথাও কোন বিপদের আশঙ্কা নেই। সবাই গ্রামে ঢুকে পড়ল, নিঃশঙ্কচিত্তে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। পেছনে পড়ে রইল ন’খানা মিরিটারী ভ্যান ও তাদের চালকরা। সৈন্যদের মধ্যে কেউ কেউ গৃহস্তদের দিয়ে ডাব, নারিকেল, কলা এবং নানারকম খাদ্য আনাতে লাগল, তারপর সেইখানেই তাই দিয়ে ভোজের উৎসবে মেতে গেল। কেউ কেউ গৃহস্থদের ভয় দেখিয়ে হাঁস-মুরগী, খাসি ইত্যাদি এনে জড়ো করতে লাগল। আবার আর একদল গৃহস্থবধূদের কাছে সোনাদানা, গয়না যা পেল সবকিছু লুটে-পুটে আনতে লাগল। এই শান্ত, ঠাণ্ডা আর ভেড়ার মত নিরীহ মানুষগুলি এর প্রতিবাদে একটি কথাও বলল না। ওরা তখনকার মত যুদ্ধবিগ্রহের কথা ভুলে গিয়ে ভোজের উৎসবে মেতে গেছে, সৈনিকের শৃঙ্খলাবোধ হারিয়ে ফেলেছে। খেয়ে-দেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আরামে এলিয়ে দিয়েছে দেহ। এমন সময় হঠাৎ একই সঙ্গে বহু রাইফেলের আওয়াজ শান্ত প্রকৃতির নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চুরমার করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল সৈন্যরা। তাদের উপর বৃষ্টিধারার মত