পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৬৯

বাড়িতে যা কিছু মূল্যবান জিনিস পেল তা লুটপাট করে নিয়ে ওরা খালের ওপারে নবগ্রাম গ্রামের বিশ্বাস বাড়িতে লুটপাট করতে গেল। বিশ্বাস-বাড়ির চিলেকোঠাটা ছিল এখানকার ছাত্রদের বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরী করবার ল্যাবরেটরী। দু'টি ছেলে সেখানে বসে তাদের সংগ্রহীত যৎসামান্য রাসায়নিক মাল-মশলা দিয়ে হাতবোমা তৈরি করত। তাদের মধ্যে একজন ছিল পাশ করা ডাক্তার। সৈন্যরা বিশ্বাস-বাড়ি আক্রমণ করতে আসছে এ-সংবাদ পেয়ে তারা তাদের তৈরি কতকগুলো হাতবোমা নিয়ে বিশ্বাস-বাড়ির কাছে একটা ঘন গাছপালায় ঢাকা ঝোপের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। সৈন্যরা তাদের নাগালের মধ্যে আসতেই তারা তাদের লক্ষ্য করে পরপর কয়েকটা হাতবোমা ছুড়ল। বিস্ফোরণের শব্দে গ্রামের শান্ত আবহাওয়া কেঁপে উঠল। ভয়ে কেঁপে উঠল পাকিস্তানী সৈন্যরা। ওরা প্রাণের ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বসে ছুটল। কিন্তু ইতিমধ্যে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে পূর্ব-নবগ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা আকাশ ফাটানো গর্জনধ্বনি করতে করতে ছুটে আসছে।

 এইভাবে আক্রান্ত আক্রমণকারী সৈন্যরা অবিরল ধারায় গুলিবর্ষণ করতে করতে পেছনে হটে যেতে লাগল। যেকোন ভাবেই হোক, এখন ওদের মেদাকুলের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ওদের গুলিবর্ষণকে অগ্রাহ্য করে ক্রমেই কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছে। অর্ধচন্দ্রাকারে ঘেরাও করে এসেছে। সৈন্যরা কোন দিকে লক্ষ্য রাখবে ঠিক করে উঠতে পারছে না। তাছাড়া তাদের ঘন ঘন 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে ওরা মাথা ঠিক রাখতে পারছিল না। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন দুঃসাহসী মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে একেবারে সামনে এসে পড়েছে। তাদের মধ্যে একজন মাত্র হাত দশেক দূর থেকে একজন সৈন্যকে তাক করে তার হাতের সড়কি ছুঁড়ল। অব্যর্থ লক্ষ্য। সঙ্গে সঙ্গে দানবের মত বিরাট দেহ সেই পাঞ্জাবী সৈন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

 যে দুঃসাহসী যুবক সড়কিটা ছুড়েছিল, তার নাম অমূল্য মল্লিক। ইতিমধ্যে আর একজন সৈন্য এগিয়ে এসে অমূল্যকে লক্ষ্য করে তার হাতের রাইফেলটা তুলেছে। অমূল্যকে রক্ষা করার জন্য মধ্যবয়সী দেবেন সরকার দু’লাফে সামনে এগিয়ে এল। সেই পেছন থেকে জাপটে ধরল সেই সৈন্যটিকে, কিন্তু ততক্ষণে সেই রাইফেলের গুলি তার লক্ষ্যস্থলে গিয়ে পৌঁছেছে। গুলিবিদ্ধ অমূল্য মল্লিক চিরতরে চোখ বুজল, তার মাতৃভূমির বুকে শিশুর মত ঘুমিয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে প্রফুল্ল সেই সৈন্যের হাত থেকে সেই মৃত্যুবর্ষী রাইফেলটাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই লেজার ঘায়ে সেই সৈন্যটির ভবলীলা সাঙ্গ হোল।

 চারজন সৈন্যের মধ্যে বাকি রইল দুইজন। ওরা পেছন দিকে ছুটতে ছুটতে সামনে একটা খালের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। খালের পাড়টা খাড়া, তার মধ্যে নেমে পড়া সহজ কিন্তু সেখান থেকে ওঠাটা সহজ নয়। তাছাড়া একগলা জলে দাঁড়িয়ে ওরা ওদের রাইফেল চালাতে পারছিল না। এই মরণের ফাঁদ থেকে ওরা উঠতে পারল না, মুক্তিযোদ্ধাদের সড়কির ঘায়ে সেইখানেই তাদের সলিল সমাধি ঘটল।

 বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার যে কর্মীরা সম্মিলিতভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবার চেষ্টা করেছিল, পূর্ব-নবগ্রামের এই প্রতিরোধ সংগ্রামের সঙ্গে তাদের প্রথম থেকেই যোগাযোগ ছিল। পাক-সৈন্যদের নিধন পর্বের মধ্য দিয়ে তাদের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। ইতিমধ্যেই পূর্বোক্ত তিনটি থানার কর্মীদের নিয়ে মুক্তিফ্রণ্ট সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। এই তিনটি থানা থেকে পঞ্চাশ জনের মত তরুণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লিখিয়েছে। এদের মধ্যে মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান সকল সম্প্রদায়ের লোক আছে। ছাত্রও আছে, কৃষকরা আছে। আরও অনেক লোক দলে আসবার জন্য উন্মুখ। কিন্তু এ বড় কঠিন জিনিস, অনেক দেখে শুনে, ভেবে- চিন্তে লোক বাছাই করতে হয়। ফ্রণ্টও গঠিত হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারাও সামনে এগিয়ে এসেছে, কিন্তু না আছে অস্ত্র, না আছে ট্রেনিং। পূর্ব-নবগ্রামে যাই হোকনা কেন, ওদের বিরুদ্ধে সত্য সত্যই তো আর সড়কি আর লেজা নিয়ে লড়াই করা চলবে না। চাই রাইফেল, নিদেনপক্ষে বন্দুক। যে করেই হোক তা সংগ্রহ করতে হবে। মুক্তিফ্রণ্টের সেক্রেটারী জনৈক তরুণ অধ্যাপক। এক বিরাট দায়িত্ব তাঁর মাথার উপর এসে পড়েছে।