সকাল পাঁচটায়। অথচ মিলিটারীর লোকেরা ইতিমধ্যে সারা শহরের পথে পথে টহল দিয়ে ফিরছে। ওরা নিশ্চয়ই সব কিছু চোখে চোখে রাখছে। এখন বাইরে চলাচল করতে হোলে সতর্কভাবে ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে হবে।
বেশ কিছু খোঁজাখুঁজির পর তিনজন এক জায়গায় মিলিত হলেন। একজন আওয়ামী লীগের, একজন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ও একজন ছাত্রলীগের নেতা। ইতিমধ্যে একটা খবর তাঁদের কাছে এসে পৌছেছে যে, ইপিআর বাহিনীর সমস্ত লোক ইতিপূর্বে তাদের জায়গা ছেড়ে দৌলতপুরের দিকে পালিয়েছে। সংবাদটা সুসংবাদ। তাঁরা তিন জনে বসে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। নিজ নিজ দলের মতামত নেওয়ার মত সময় ছিল এখন সমন একটা সময়, যখন ভুল হোক বা শুদ্ধ হোক, যা করবার নিজেদের দায়িত্বেই করতে হবে। এই পরিকল্পনা নিয়ে এই তিন জন অতি সঙ্গোপনে শহর ছেড়ে দৌলতপুরের দিকে চলে গেলেন।
ইপিআর বাহিনীর পলাতক লোকেরা দৌলতপুর থেকে চার মাইল দূরে রংপুর, শাহপুর, লতা প্রভৃতি প্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। গ্রামবাসীদের ঘরের দরজা তাদের জন্য অবারিত, তারা নিতান্ত আপনজনের মত তাদের নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছে। এতো যে বিপদের আশংকা আছে, এ কথাটা কি তাদের জানা ছিল না? ছিল বৈকি। কিন্তু স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে হলে দুঃখ আর বিপদ আর মৃত্যুর সম্মুখীন হতেই হবে। এই পলাতকের দল প্রাণ বাচানোর জন্য পালিয়ে এসেছিল একথা সথ্য, কিন্তু সেটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। তার চেয়েও বড় কথা, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পশ্চিমা শাসকদের জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে। যদি প্রাণ দিতে হয়, প্রাণ দেবে। সারা বাংলাদেশের মানুষ যে অনেক আশা করে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই পালিয়ে আসার সময় তারা যত বেশী সম্ভব রাইফেল, কার্তুজ আর গোটা কয়েক লইট মেশিনগান সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
যে তিনজন স্থানীয় নেতা এদের সন্ধানে শহর থেকে চলে এসেছিলেন তাঁরা এদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেন। পরামর্শ করলেন এবং তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই বাহিনী অবিলম্বে দ্রুত মার্চ করে খুলনা শহর দখল করে নেবে।
ইপিআর আর পুলিশ মিলে এই বাহিনীতে শ'তিনেক লোক ছিল, তাছাড়া তাদের সঙ্গে কিছু সংখ্যক সাধারণ লোকও ছিল। যে তিন জন রাজনৈতিক নেতার কথা আগে বলেছি, তাঁরা প্রথম থেকেই এদের সঙ্গেই ছিলেন এবং এই বহিনীকে সংগঠন করা আর এই আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করবার পেছনে তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। রংপুর, শাহপুর ও লতা এই তিনটি গ্রামের মাঝখানে আড়ংঘাটা ময়দান। এরা সুশৃঙ্খলভাবে সেই ময়দানে জমায়েত হোল, তারপর শহর দখলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। বেশ কিছুদূর এগিয়ে আসার পর তেলিগাতি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে শত্রুপক্ষের সঙ্গে প্রথম মোকাবিলা করল।
কলেজের কাছে পঁচিশ/ত্রিশ জন পাক-সেন্য পাহারা দিচ্ছিল। সে কথাটা এদের অজানা ছিল না। তারা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে অভিসন্তর্পণে এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এভাবে আচমকা আক্রান্ত হয়ে পাক-সৈন্যদের সেই ছোট দলটি কিছুটা দিশাহার হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণের গুলিবর্ষণের পর তারা কুড়িটি মৃতদেহ ফেলে রেখে পালিয়ে গেল। সেই সংঘর্ষে এ পক্ষের মাত্র দু'জন পুলিশ মারা গিয়েছিল।
এরা পালিয়ে যাওয়ার ফলে একটা ট্রাক ও গোটা কয়েক জীপ মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে গেল। প্রায় পঞ্চাশ জন মুক্তিযোদ্ধা এই গাড়িগুলিতে চেপে পলাতক শত্রুর পেছনে পেছনে ধাওয়া করে এগিয়ে চলল। মুক্তিবাহিনীর বাকি যোদ্ধারা যানবাহনের অভাবে পায় হেঁটে আসছিল। তারা কিছুটা পেছনে পড়ে গেল।
মুক্তিবাহিনীকে বাধা দেয়ার জন্য প্রায় আড়াইশ' পাক-সৈন্য দৌলতপুরের ‘বৈকালী' সিনেমার কাছে অপেক্ষা করছিল। মুক্তিবাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখে তারা পাবলিক লাইব্রেরি ও গার্লস কলেজে ঘাঁটি করে বসল।