পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৭৭

এবার দু'পক্ষের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মত সংঘর্ষ ঘটল। নিউজপ্রিণ্ট পেপার মিলের সামনে কিছুসংখ্যক ই,পি,আর,— এর লোক মোতায়েন করা ছিল। তারা এসে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিল। শুধু তারাই নয়, নিউজপ্রিণ্ট পেপার মিলের একদল শ্রমিকও তাদের সঙ্গে এসে সামিল হোল। এবার মুক্তিবাহিনী এক নতুন কৌশল গ্রহণ করল। দু'পক্ষের যখন যুদ্ধ চলছে তখন মুক্তিবাহিনী পেছন দিককার অংশটা প্রতিপক্ষের দৃষ্টির আড়ালে বিল অঞ্চল দিয়ে ওদের পেছনে দিক দিয়ে হানা দিল। হঠাৎ এভাবে দু'দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে পাক সৈন্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাদের ঘাঁটি ছেড়ে দ্রুত পশ্চাদপসরণ করল। এই সংঘর্ষের ফলে তাদের বেশ কিছু লোক মারা গিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী উল্লাস-ভরে জয়ধ্বনি দিতে দিতে গার্লস কলেজ ও পাবলিক লাইব্রেরি দখল করে নিল।

 কিন্তু এই তো সবে সূচনা। আসল যুদ্ধের তখনও অনেক বাকি।

 একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণকারী জঙ্গী বাহিনী, অপরদিকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ। এ নহে কাহিনী, এ নহে স্বপন, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য মারতেও জানে, মরতেও জানে। খুলনা শহরের রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে তারা এই সত্যটিকে প্রমাণিত করেছিল। এই যুদ্ধ একটানা ছত্রিশ ঘণ্টা পর্যন্ত চলেছিল।

 মুক্তিবাহিনীর এই প্রবল একটানা আক্রমণের সামনে প্রতিপক্ষ শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারত না। যথেষ্ট সৈন্য থাকলেও এবং উন্নততর আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হলেও নৈতিক দিক থেকে এরা ছিল দুর্বল। কিন্তু বাইরে থেকে আর একদল সৈন্য এদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার ফলে ওদের শক্তি আশাতীতভাবে বেড়ে গেল। খুলনার রক্ষা ব্যবস্থাকে দৃঢ় করে তোলবার জন্য ২৪-এ মার্চ তারিখে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে যানবাহন ও আধুনিক সমরোপকরণে সজ্জিত এক বিরাট সৈন্যবহিনী রওনা হয়েছিল। কিন্তু তারা বিনা বাধায় আসতে পারেনি। পথের মাঝখানে দেশপ্রেমিক জনতা তাদের রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারা প্রথম বাধা পায় যশোর জেলার অন্তর্গত নওয়াপাড়া গ্রামে।

 এখানে ই,পি,আর-এর কোন সশস্ত্র লোক ছিল না। তবু দুঃসাহসী পুলিশ, ছাত্র ও সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই দুর্বল ও ভঙ্গুর বাধাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে হামলাকারীর দল তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলল। ওরা দ্বিতীয়বার বাধা পেলো খুলনা জেলার ফুলতলা অঞ্চলে। মুক্তিবাহিনী এদের অগ্রগতিকে প্রতিরোধ করবার জন্য তাদের বাহিনীর একটি অংশকে পাঠিয়েছিল। ফুলতলা অঞ্চলে দু'পক্ষের সংঘর্ষ ঘটল। সেখানে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলেছিল। এদের এই প্রবল আক্রমণের ফলে যশোর থেকে আগত পাক-সৈন্যবাহিনী যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ভোগ করার পর মধ্যপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল।

 একটা অংশ তাদের হতাহত সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে যশোরের দিকে ফিরে চলে গেল। কিন্তু বৃহত্তর অংশটি খুলনা শহরে রণক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চলল। এদের সঙ্গে ছিল পঁয়ত্রিশটি গাড়ি বোঝাই সৈন্য, আর ষোলটি কামান সজ্জিত জীপ। ফুলতলা থেকে খুলনা শহর ষোল মাইল দূরে, পথের মাঝখানে সংগ্রামী জনতা বহু বাধা ও ব্যারিকেডের সৃষ্টি করে তুলেছিল, যার ফলে এই ষোল মাইল পথ অতিক্রম করতে এদের আঠারো ঘণ্টা সময় লেগেছিল।

 যশোরের সৈন্যদল এসে পৌঁছবার পর পাক-সৈন্যবহিনীর শক্তি বহু পরিমাণে বেড়ে গেল। শুধু সৈন্য-সংখ্যার দিক দিয়েই নয়, এরা ষোলটা মর্টার নিয়ে এসেছে। অপর দিকে খুলনা শহরের শ্রমিক ভাইয়েরা দলে দলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে চলেছে। এরা মৃত্যুভয় ভুলে গিয়ে উন্মত্তের মত যুদ্ধের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে।

 যখন দু'পক্ষে প্রবল হানাহানি চলছে, তখন হঠাৎ দেখা গেল পাক-সৈন্যবাহিনী একটু পেছনে চলে গিয়ে শ্বেতপতাকা তুলে ধরেছে। তার মানে এরা আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। থেমে গেল যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর লোকেরা