জন্য হলেও তারা এটাকে নিজেদের দখলে রাখবে এবং এর মধ্য দিয়া সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছ স্বাধীন বাংলার বাণী ছড়িয়ে দেবে।
সে সময় আঠারো জন পাক-সৈন্য বেতার ঘাঁটি পাহারা দিচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা 'আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের আঠারো জনকেই খতম করল। পাহারাদার পাক-সৈন্যরা তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে নিজেরাই গুলি চালিয়ে বেতার ঘাঁটির ট্রান্সমিটারগুলিকে নষ্ট করে দিয়েছিল। ফলে বেতার ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এল বটে, কিন্তু তারা তাকে তাদের কাজে লাগাতে পারল না। বেতার ঘাঁটি দখল করার ফলে তাদের হাতে একটা মেশিনগান, ছয়টা গ্রেনেড এবং আরও কিছু অস্ত্রশস্ত্র এসে গিয়েছিল।
রাতটা কেটে গেল। ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শত্রুপক্ষকে মোকাবিলা করবার জন্য শহরের এক প্রান্তে প্রতিরোধ ঘাঁটি তৈরী করে অপেক্ষা করছিল। এই শক্তিশালী শত্রুদের পরাজিত করতে বা হটিয়ে দিতে পারবে না, একথা তারা ভাল ভাবেই জানতে, কিন্তু যাবার আগে তাদের একটু শিক্ষা দিয়ে যেতে হবে।
সকাল হতে না হতেই পাক-সৈন্যবাহিনী তাদের আক্রমণ করাবর জন্য দ্রুত গতিতে এগিয়ে এল। প্রথমে তিন লরী বোঝাই সৈন্য, তারপর কতকগুলি খালি গাড়ি, অবশিষ্ট সৈন্যরা মার্চ করে আসছে। ওরা নাগালের মধ্যে আসতেই মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি লরীকে লক্ষ্য করে ছ'টি গ্রেনেড ছুড়ল। এই গ্রেনেডগুলিকে তারা বেতার ঘাঁটির মধ্যে পেয়েছিল। অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রেনেড। গ্রেনেড ছোড়ার ফলে তিন লরী বোঝাই সৈন্য লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।
এই মারাত্মক দুর্ঘটনার ফলে তাদের পেছনে যে সৈন্যরা আসছিল, তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করার পর ওরা বুঝতে পারল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আর গ্রেনেড নেই, এবার নিশ্চিন্ত মনে এগোনো যেতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় এদের সৈন্যসংখ্যা অনেক বেশী। তাদের হাতে মাত্র একটি মেশিনগান, বাকী সবই রাইফেল। এ অবস্থায় দু'পক্ষে বেশীক্ষণ লড়াই চলতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আশাতীত সাফল্যের ফলে খুবই খুশী হয়েছিল। এবার তারা আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে দ্রুত সরে পড়বার জন্য চেষ্টা করল। পাক-সৈন্যরা তাদের এই উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তাদের খতম করে দেবার জন্য দ্বিগুণ বেগে ধাবিত হোল। তাদের একটা অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশ কাটিয়ে তাদের ঘেরাও করে ফেলবার জন্য চেষ্টা করছিল। মুক্তিবাহিনীর নেতা বুঝতে পারলেন তাঁরা এক ভীষণ সংকটজনক অবস্থায় এসে পড়েছেন। শত্রুপক্ষের সঙ্গে গাড়ি আছে, আর তাদের পায়ের উপর নির্ভর করে ছুটতে হবে। এ অবস্থায় এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সহজ কথা নয়। যদি বাঁচতে হয় তবে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে, কিছ সংখ্যক লোকের মায়া ছেড়ে দিয়ে বাকি সবাইকে বাঁচাতে হবে।
দু'পক্ষের মাঝখানে তখনও কিছুটা ব্যবধান ছিল। নেতা নির্দেশ দিলেন; কয়েকজনকে প্রাণের মায়া ছেড়ে দিয়ে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। বাকি সবাই যতক্ষণ নিরাপদে পালিয়ে যেতে না পারে, ততক্ষণ এরা যতই বিপদ ঘটুক না কেন, পেছনে হটবে না, সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে হবে। এর নাম সুইসাইড স্কোয়াড। এভাবে আত্মবলিদান দিতে প্রস্তুত আছে কারা, তিনি আহবান জানালেন। একটু সময় সবাই চুপ করে রইল, তারপর সামনে এগিয়ে এল ছ'জন। নিজেদের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আর সকলের আত্মরক্ষার সুযোগ করে দেবে।
এই রণকৌশল সার্থক হোল। সেদিনকার সেই ছ'জন মুক্তিযোদ্ধা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে করতে শত্রুদের হাতে ধরা পড়ল। বাকী সবাই নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করে চলে এল। এইভাবেই খুলনার মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল।