পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৭

সেদিন সকল অবাঙ্গালী সিপাহী তাদের পদস্থ অফিসারদের নির্দেশ ও মর্যাদা একেবারে উলঙ্গভাবে, পুলিশের ইতিহাসে এই প্রথম, অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে সম্মিলিতভাবে একযোগে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। অবাঙ্গালী সিপাহীদের রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার পর আমরা আসন্ন বিপদের কথা বুঝতে পারি এবং আমার অধীন বাঙ্গালী সিপাহীদের হাতে অস্ত্র দিয়ে পুলিশ লাইনের সকল প্রবেশপথে তাদেরকে কড়া প্রহরায় নিযুক্ত করি। পুলিশ লাইনের চারটি প্রবেশপথে চারজন হবিলদারের সাথে ছয়জন করে সশস্ত্র সিপাহী মোতায়েন রাখি। আমি খুব চিন্তাযুক্তভাবে পুলিশ লাইনে টহলরত ছিলাম। আমি এক সময় দোতলা থেকে অস্ত্রাগারের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছিলাম। এমন সময় অস্ত্রাগারের ভিতরের টেলিফোনটি বেজে উঠলে আমার কর্তব্যরত নায়েক চীৎকার করে আমাকে টেলিফোন ধরতে বলে। আমি দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরলাম। অস্ত্রাগারের সেই টেলিফোনে এর ভীতসন্ত্রস্ত কাঁদো কাঁদো কম্পিত কণ্ঠ চাপাচাপা অস্ফুট কণ্ঠে বলছিল “মিলিটারী হেডকোয়ার্টারে বহু সশস্ত্র আর্মি ট্রাক লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা এক্ষুনি রাজধানী আক্রমণ করতে যাচ্ছে”। সেই ভীত কণ্ঠ আরো বলছিলো- “ওদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ই-পি-আর হেডকোয়ার্টার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল।” এ কথা বলেই সেই কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেলো। “কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন”? আমি চীৎকার করে এসব প্রশ্ন করার সাথে সাথে টেলিফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। সিপাহীরা টেলিফোনের এ মারাত্মক সংবাদ লাইনের সর্বত্র চীৎকার করে ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। এ সংবাদে সকল সিপাহী অস্ত্রাগারের দিকে ছুটে এসে টেলিফোনের সংবাদ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতে থাকে। এ সময় আমি লাইনে বসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের তৎকালীন আর-আই মিঃ মফিজউদ্দীনের সাথে তার বাসায় টেলিফোনে যোগাযোগ করে ঢাকা সেনানিবাস থেকে বাঙ্গালী কণ্ঠ ভেসে আসা পাক সেনাদের রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে সদম্ভে ধেয়ে আসার সংবাদ বিস্তারিত জানালে তিনি তৎকালীন পুলিশ সুপার ই, এ, চৌধুরী সাহেবকে সব কিছু জানাচ্ছেন বলে টেলিফোন ছেড়ে দেন। এদিকে আমার সিপাহীরা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের চারশত বাঙ্গালী সিপাহী বলছিলো “অস্ত্র দাও, অস্ত্র দাও। আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দাও, আমরা ওদের প্রতিরোধ করবো, প্রতিহত করবো।” শেষ পর্যন্ত অস্ত্রাগারের সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাবিলদার সহকর্মীরা বুকফাটা চীৎকারে রাজারবাগ কাঁপিয়ে তুলে বলছিলো “আমাদের হাতে অস্ত্র দাও, আমরা লড়বো, লড়তে লড়তে মরবো, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করবো ঐ বেঈমানদের বিরুদ্ধে কিন্তু পিছু হটবো না, হটবো না।” এরপর আমি রিজার্ভ ইন্সপেক্টর সাহেবের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে আমাদের ফোর্সের সুবেদার আবুল কাসেমকে এ সংবাদ জানালে তিনি লাইনে ছুটে আসেন। এর পরপরই আমাদের আর-আই সাহেব পুলিশ সুপার ই.এ চৌধুরীর সাথে আলাপ আলোচনা করে লাইনে এসে বলেন, “তোমরা ওদের রুখতে পারবে না কোন প্রকারেই, দেখ আমাদের নীরব থাকাই ভালো-।” কিন্তু তখন নীরব থেকে প্রাণ বাঁচাবার কোনো উপায় ছিল না। পুলিশ লাইনের সকল বাঙ্গালী সিপাহীই তখন অস্ত্র নিয়ে ওদেরকে প্রাণপণ প্রতিরোধ করার জন্য ব্যাকুল ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। সিপাহীরা বলছিলো, “আর-আই সাহেব আপনি অস্ত্রাগার খুলে দিন, আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিন, আমরা ওদের প্রতিরোধ করবো।” এরপর আর-আই সাহেব অস্ত্রাগারের চাবি দিয়ে দিলে বাঙ্গালী সিপাহীরা সবাই পাগলের মতো অস্ত্রাগারে প্রবেশ করে যার যার প্রয়োজন মতো রাইফেল ও গুলি হাতে তুলে নেয়। এ সময় চারিদিক থেকে হাজারো জনতা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রবেশ করে আমাদের অস্ত্রাগার থেকে বিনা বাধায় অস্ত্র নিয়ে যায়। এসময় আমাদের অফিসাররা বাইরে কর্তব্যরত ছিলেন। এ সময় সুবেদার ফোর্স আবুল কাসেম, আর ও হাফিজুর রহমান, সার্জেণ্ট মুর্তজা হোসেন, সুবেদার আবুল হাসেম, নায়েক মোহাম্মদ আলী (ফুটবল খেলোয়াড়) সবাই সশস্ত্রভাবে আমাদের সিপাহীদের সাথে মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তৈরী ছিলেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিয়ে সমস্ত সিপাহী লাইনের চারিদিকে মাটিতে শুয়ে, ছাদের উপর বসে থেকে, দাঁড়িয়ে থেকে, গাছের আড়ালে থেকে পজিশন নিয়ে পাক পশুদের অপেক্ষায় ছিলো। সেদিন হাবিলদার তাজু আহমেদ, হাবিলদার আবুল হোসেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুটবল খেলোয়াড় নায়েক মোহাম্মদ আলী, হাবিলদার আতাউর রহমান, সিপাহী মোহাম্মদ আলী, আরও কতিপয় হাবিলদার, নায়েক ও