পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৫৩

 বাঘা সিদ্দিকীর সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমি মিলিত হয়েছিলাম। আমার টেপ রেকর্ডারে তিনি একনাগাড়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা তাঁর বক্তব্য রাখেন। ২৫শে মার্চের পরবর্তী পর্যায়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বাহিনী সংগঠন থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়ের কথা বলেন।

 কাদের সিদ্দিকী বলেন যে, কোন বাহিনী গঠনের মানসিকতা নিয়ে অন্তত প্রথম অবস্থায় তিনি যুদ্ধে নামেননি। তিনি বললেন, যখন ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া আমাদের উপর তার বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমি আগে ভাবতাম কোন কিছুর সমাধান হিংসাত্মক উপায়ে হয় না। ২৩শে মার্চ আমরা অধিকার আদায়ের শপথ নিলাম। এবং সেদিন প্রথম সবক নিলাম প্রয়োজন হলে অস্ত্রের মাধ্যমেও রাজনীতি করতে হতে পারে। ২৫শে মার্চের পর টাঙ্গাইলে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেখানে আমার কোন যোগ্যতা নেই। তার জন্যে কোন দায়িত্ব না পেলেও নিজে একজন কর্মী হিসাবে থাকার চেষ্টা করলাম। আমি আগে থেকেই জানতাম রাজনীতির মঞ্চের নেতৃত্ব আর যুদ্ধের নেতৃত্ব এক জিনিস নয়।

 ৩রা এপ্রিল, ১৯৭১ সাল। হানাদার পাক বাহিনী এগিয়ে এলো টাঙ্গাইলের পথে। তাদেরকে সাটিয়াচড়ায় বাধা দেয়া হয়, বললেন কাদের সিদ্দিকী। সেই যুদ্ধ প্রাক্তন ই.পি আররাই করেছিল। মাত্র ২ প্লাটুন ইপিআর সেদিন বাধা দেয় হানাদার খান সেনাদের একটি ব্যাটালিয়নকে। যুদ্ধে আমাদের হার হয়। ভাবলাম পাহাড়ে পালিয়ে চলে যাবো। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাবো না। যা হয় দেশেই হবে।

॥ শত্রুর মোকাবিলা করেই কাদের বাহিনী যুদ্ধ শিখছে ॥

 ১৯শে এপ্রিল। ময়মনসিংহের পথে রওনা হয় পাকবাহিনী। পথে কালিহাতীতে তাদের বাধা দেয়া হয়। নেতৃত্বে ছিল ইপিআর-এর। কাদের সিদ্দিকীও এদের সঙ্গে অংশগ্রহন করেন। শত্রুপক্ষের মেজর কামালসহ বহু খান সেনা এই যুদ্ধে হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ডিফেন্স উঠিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এদিকে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাদের সিদ্দিকী। সঙ্গে রয়েছেন কয়েকজন মুক্তিপাগল যুবক। কাদের সিদ্দিকী বলছিলেন, আমার আয়ত্তে কুড়ি পঁচিশটি বন্দুক ছিল। এগুলো নিয়ে পাহাড়ে চলে গেলাম। লুকিয়ে রাখলাম। কয়েকদিন পর শুনতে পেলাম কাদের বাহিনীর মাথা কেউ এনে দিতে পারে তাকে লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। ভয় পেলাম প্রথমে। আমাদের দেশে হাজার টাকার জন্য মানুষ মানুষকে খুন করে। আমাকে তো ধরিয়েও দিতে পারে। অনেকগুলো যুবক ও তরুণ আমার সাথে গিয়েছিল। তাদের কয়েকজনকে ফিরিয়ে দিলাম। আমি তখন কিছুটা ফ্রাস্ট্রেটেড। আমি পারবো কিনা সন্দেহ ঢুকছে মনে। আমি যে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পারবো তা তখন আমার জানা নেই। সহগামী বন্ধুদের বললাম, তোমরা চলে যাও। তোমরা এখনো দোষী সাব্যস্ত হওনি। আমি মনস্থির করলাম এমনিভাবে পালিয়ে পালিয়ে থাকবো। যদি কোনদিন সুযোগ পাই এবং একজন পাসসেনাকেও হত্যা করতে পারি তাহলে মনে সান্ত্বনা পাবো তবু তো একটাকে মারলাম।

 কাদের সিদ্দিকী বললেন, কিন্তু পরে দেখলাম আমাকে জঙ্গলে কাটাতে হলো না। মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ পাগল। সংগ্রামের জন্য তাদের দারুণ আগ্রহ। লাখ টাকার বিনিময়েও তারা ধরিয়ে দিতে রাজী নয়। এভাবে কয়েকদিন কেটে গেলো। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছেলেরা এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, কাদের ভাই, কোথায় ট্রেনিং হচ্ছে? আপনি কোথায় ট্রেনিং দিচ্ছেন, বলুন। বুকে অনেক ভরসা পেলাম। রিক্রুট শুরু করলাম। ৬ই মে নাগাদ আমার দলের লোকসংখ্যা দাঁড়ালো ৪০০ জন। ১৪ই মে বহেরাতৈলে পবিত্র কোরআন হতে নিয়ে আমার জওয়ানদের শপথ করালাম যতদিন বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, বঙ্গবন্ধু ফেরত না আসবেন, ততদিন আমাদের যেই জীবিত থাকি যুদ্ধ করবো। সেই থেকে আমাদের সুপরিকল্পিত যুদ্ধ শুরু হলো।

 কাদের সিদ্দিকী বললেন, অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমি চেষ্টা করেছি আমাকে ছায়া দেয়ার মতো এবং নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাউকে যদি পেতাম। আমরা তার হুকুম মেনে কাজ করতাম। অনেকে এসেই আমার সাথে যোগদান করেছে। প্রথমে ভেবেছি এই বোধ হয় কোন নেতা পাবো। কিন্তু পরে দেখেছি তারা আমাকে নেতৃত্ব