পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৭৮

 কোটালীপাড়ায় আরও তিন জায়গায় পাকবাহিনীর ঘাঁটি ছিল- ঘাগোর গুদাম ঘর, কুরপালামূ কম্যুনিটি সেণ্টার এবং গোপালগঞ্জ মাদ্রাসায়। ডিসেম্বর মাসের শুরুতেই চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে এই সব ঘাঁটি নাস্তানাবুদ করে দেয়া হয়। ৩ রা ডিসেম্বর যুদ্ধের ফলে চুড়ান্তভাবে এই থানা মুক্ত হয়ে গেল। এই যুদ্ধে জেলা অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নুর মোহাম্মদ বাবলুও তার সাথে ছিল।

 হেমায়েত বাহিনীর কর্মক্ষেত্র ছিল বরিশালের উজির পুর ও গৌরনদী থানা, ফরিদপুরের কালকিনি, মাদারীপুর, রাজৈর, গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া। মকসুদপুর, কাশিয়ানী এবং খুলনার মোল্লারহাট থানার অংশ বিশেষ ও তার কর্মক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

 সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণভাবে গড়ে উঠেছিল এই হেমায়েত বাহিনী। তার দলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল ৫০৫৪ জন। তাদের মধ্যে নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী লোক ছিল ৩৪০ জন। এদের সাহায্যে তিন কোটালীপাড়া থানার জহরের কান্দি হাইস্কুলে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলেন এবং তিন মাসে প্রায় চার হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ দান করা হয়। এদের মধ্যে দেড় হাজার গরীব শ্রেনীর মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ৯৫.০০ টাকা হিসেবে বেতনও দেয়া হতো। কোটালীপাড়া, নারকেলবাড়ীর চার্চমিশনে একটি সংক্ষিপ্ত নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেও খোলা হয়েছিল। সেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি হাসপাতালও পরিচালনা করা হত।

 আগেই বলা হয়েছে হেমায়েত বাহিনী ছিল সম্পূর্ণভাবে অভ্যন্তরীণভাবে গড়ে ওঠা একটা সংগঠন। এদের অস্ত্রশস্ত্রের বেশীর ভাগই ছিল পাকবাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া। তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আঠারটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন। এই বিরাট সাফল্য মূলতঃ হেমায়েতউদ্দিনের নিষ্ঠা এবং তার সঙ্গীদের দায়িত্ববোধ আন্তরিকতা ও আনুগত্যের ফলেই সম্ভব হয়েছে। দেশের স্বধীনতা যুদ্ধে এমন একক প্রচেষ্টায় অভ্যন্তরীণভাবে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানের নজীর বিরল। বাংলাদেশের সরকার এই বীর যোদ্ধার কৃতিত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ তাঁকে 'বীর বিক্রম' খেতাবে ভূষিত করেন।

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন-১

সাক্ষাৎকার[১] : মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া) বীর বিক্রম

 মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে অর্থাৎ মে মাসের শেষের দিকে আগরতলার এক ক্যাম্পে আমাদের ‘কমাণ্ডো’ আক্রমণের কলাকৌশল সম্পর্কে ক্লাশ নিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার (পরবর্তীকালে কর্নেল)। ক্লাশ চলাকালে ক্যাম্প পরিদর্শনে এলেন ২নং সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ (পরবর্তীকালে ব্রিগেডিয়ার)। সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে দৃঢ় করার জন্য সংক্ষিপ্ত এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। এরপর তিনি একটি 'সুইসাইড স্কোয়াড' গঠন করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই স্কোয়াড পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য ছিলো ঢাকা শহরে দখলদার সামরিক বাহিনীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, সেই সঙ্গে বিদেশী সাংবাদিক এবং বিদেশী অর্থনৈতিক সাহায্যদাতা সংস্থার লোকজনের মধ্যে এই ধারণা দেয় যে, ঢাকা শহরের কেন্দ্রবিন্দুতেও মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।

 জুনের প্রথমে আমাদের ১৬ জনের দলটি ঢাকার দিকে রওয়ানা দেয়। আমাদের এই ১৬ জনের কাছে জনপ্রতি ৪টি করে গ্রেনেড এবং ২০ পাউণ্ড করে বিস্ফারক ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। ঢাকা আসার পথে


  1. 'রোববার' বিজয় দিবস সংখ্যা, ১৯৮১-এ প্রকাশিত জিল্লুর রহিম-রচিত 'ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সকল অভিযান' শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।