পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৮১

ব্যাংক ইত্যাদিতে প্লাস্টিক সাইন সরবরাহ হতো আমার কারখানা থেকে। সে সময় যেহেতু ঢাকায় বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক প্রভৃতির কর্মকর্তাদের অধিকাংশই ছিল অবাঙ্গালী, সেহেতু তাদের সাথে আমার ব্যবসায়িক যোগাযোগের সুবাদে আমি পাঞ্জাবী ও উর্দু ভাষাটা ভালোই শিখেছিলাম। এটা ঢাকায় গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা কালে আমার পক্ষে অনুকূল হয়েছিল। অনর্গল উর্দু ও পাঞ্জাবী ভাষা বলতে পারার কারণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাস্থানীয় কোনও অবাঙ্গালী আমাকে ঢাকায় গেরিলাযুদ্ধের একজন সংগঠক বা সহায়তাকারীরূপে সন্দেহ করতে পারেনি।

 যা হোক, ২৫ মার্চ সন্ধ্যে থেকে যখন সমস্ত শহরের পরিস্থিতি ক্রমেই থমথমে হয়ে উঠছিল এবং পাকিস্তানী সামরিক কার্যক্রমের আসন্নতা যখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল তখন আমার কারখানার কিছুসংখ্যক কর্মী এবং আমার বাড়ির পার্শ্ববর্তী আলী ডেকরেটরের আরও কিছু লোকজন মিলে নিউ ইস্কাটন রোডের কিছু জায়পায় গর্ত করা শুরু করে এবং দিলুরোডসহ আশেপাশের এলাকায় বহু ঠেলাগাড়ি জমা করে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে যেন পাকবাহিনী এই পথ দিয়ে অগ্রসর হতে না পারে। আমাদের আশংকা বাস্তবে রূপ নিতে বেশী দেরী হল না। রাতের মধ্যেই বাংলা মোটর (তৎকালীন পাকমোটর) হয়ে নিউ ইস্কাটন রোড ধরে পাকবাহিনীর সামরিক যানগুলি এগিয়ে এলো। মনে আছে, সামনের যে জীপগুলি ছিল, সেগুলির বাতি ছিল হলুদ রঙের। গাড়িগুলি আমাদের তৈরী ব্যারিকেডের সম্মুখীন হতেই প্রচণ্ড ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল। ফায়ারিংয়ের মুখে রাস্তাঘাট মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে গেল। আমরাও আত্মরক্ষার্থে বাসার ভেতরে আশ্রয় নিলাম। উন্মত্ত গাড়িগুলি ব্যারিকেড চুরমার করে মৌচাক হয়ে রাজারবাগের দিকে ছুটে যায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করতে পাকিস্তানী সামরিক যান এই নিউ ইস্কাটন রোডই ব্যবহার করেছিল।

 ঢাকা শহর পাক কবলিত হওয়ার পর এপ্রিলের শেষের দিকে আমার বিশিষ্ট বন্ধু তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট হামিদুল্লাহ খানের- যিনি পরে ১১নং সেক্টর অধিনায়ক কর্নেল তাহের আহত হওয়ার পর ঐ সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সাথে তাঁর ধানমণ্ডির বাড়িতে একদিন দেখা হয়। তিনি তখন পাক বিমানবাহিনী থেকে ডিফেক্ট করার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু ঠিক উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আমি তার পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হলে তিনি আগরতলা চলে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন। এ ব্যাপারে আমি যোগাযোগে সাহায্য করি।

 এ সময় আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গেরিলা ট্রেনিং চলার কথা শুনতে পাই, এবং কোনও গেরিলা দলের খোঁজ পাই কিনা তার জন্য অনুসন্ধান চালাতে থাকি। এই অবস্থার মধ্যে আমার বাড়ির নিকটের প্রতিবেশী পাকিস্তান রেডিও-এর একজন কর্মচারী হাফিজ ভাইয়ের বাসায় হঠাৎ একটি ছেলের মুখে মুজিবনগর এলাকায় জোর গেরিলা ট্রেনিং চলার কথা শুনতে পাই। আরও শুনতে পাই যে, অতি শীঘ্রই ভারত থেকে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা চালানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা দল পাঠানো হবে। খবর শুনে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি এবং সত্যি সত্যি এরূপ গেরিলা দল এলে আমি তাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করার আগ্রহ প্রকাশ করি। ছেলেটি তার নিজের আইডেণ্টিটি গোপন রেখে শীঘ্রই একজন গেরিলা যোদ্ধাকে আমার কাছে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এর সপ্তাহ দু'য়েক পরেই হঠাৎ এক সকালে আমার বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে একটি ছেলে এসে হাজির। সে এসে দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে আমার খোঁজ করতেই আমি তার কাছে আমার পরিচয় দিলাম এবং তাকে নিয়ে এসে আমার ড্রয়িংরুমে বসালাম। আমি গেরিলাদের যুদ্ধে সাহায্যদানে ইচ্ছুক কিনা সরাসরি জানতে চাইলে আমি তাকে আমার পূর্ণ সম্মতি জ্ঞাপন করি। নিশ্চিন্ত হয়ে সে তখন গাজী দস্তগীর বলে নিজের পরিচয় দেয় এবং খুব শীঘ্রই সে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করবে বলে আমাকে জানায়। ঢাকায় গেরিলাদলের সাথে এ ভাবেই আমার প্রাথমিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে, এবং আমি তাদের কিভাবে সাহায্য-সহায়তা করতে পারি সেসম্পর্কে চিন্তা করতে শুরু করি। আমার কিছু পূর্ব সামরিক জ্ঞান ছিল এবং বেশকিছু সামরিক অফিসারের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। ভেতরে দেশপ্রেম কাজ করছিল, তারই প্রেরণায় আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত একটি হৃদয়হীন শক্তির মুখে সামরিক ছাউনি পরিবেষ্টিত ঢাকা শহরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিরোধের শিখা জ্বালাতে আমি আমার