পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৮২

সামান্য সীমিত শক্তি নিয়োগে সংকল্পবদ্ধ হই। এটা সুবিদিত যে, গেরিলারা জনবিছিন্নভাবে কোনো কাজ করতে পারে না। গণসমর্থন তাদের কাজের অপরিহার্য প্রাথমিক শর্ত। সে জন্য আমি প্রথম যে কাজটি করেছিলাম সেটা ছিল ঢাকায় আগত প্রথম গেরিলাদের জন্য শেলটারের ব্যবস্থা করা।

 গাজী দস্তগীরের সাথে আলাপের কয়েকদিন পরই সে কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে আমার বাসায় চলে আসে। এরা ছিল ২ নং সেক্টরের মেলাঘর, নির্ভয়পুর প্রভৃতি স্থানে আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে যাদের নাম এখনো আমার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল তারা হচ্ছেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (মায়া ক্র্যাক প্লাটুনের দায়িত্বপ্রাপ্ত), উলফত, জুয়েল এবং আরো দু'টি ছেলে যাদের নাম এখন আমার স্মরণে নেই। গাজী দস্তগীর এদের সবাইকে একে একে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানায় যে, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধের উপযোগী অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে করে এনেছে। তখন গেরিলাদের ঢাকা প্রবেশের রাস্তা ছিল দু'টি- একটি বিবিরবাজার-কুমিল্লা হয়ে, অপরটি মীরপুরের নদীপথে মালিবাগ পর্যন্ত। গেরিলারা আমাকে জানালো, যে অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়েছে সেগুলি তারা মালিবাগের একটি বাসায় রেখে এসেছে, রাস্তায় রাস্তায় পাকবাহিনীর জোর তল্লাশী চলায় সেগুলো তারা আমার বাসা পর্যন্ত আনতে সাহস পায়নি। অস্ত্রগুলি দু'টি বস্তায় ভর্তি। একটিতে ছিল কয়েকটি স্টেনগান, চাইনিজ রাইফেল, বুলেট ইত্যাদি। অপরটিতে ছিল, যাকে বলা হয় প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, অনেকটা গোলানো ময়দার মতো দেখতে, প্লাস্টিকের থলিতে ভর্তি। এ ছাড়া ছিল বিস্ফোরণ ঘটানোর অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী।

 গেরিলারা অস্ত্রগুলি নিরাপদে রাখার ব্যাপারে স্বতঃই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। আমি তাদের এ ব্যাপারে আশ্বাস দিই, গাজী দস্তগীরের পরিচিত দু'টি ছেলেসহ আমার নিজের টয়োটা করোলা গাড়ি নিয়ে মালিবাগের সে বাসায় চলে যাই এবং বস্তাভর্তি অস্ত্রগুলি নিয়ে আসি এবং আমার অফিসের স্টীলের আলমারি খালি করে তাতে সেগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করি। দলে তখন আমরা ছিলাম মোট ৭ জন। আমাদের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতেই হবে, এই ছিল প্রতিজ্ঞা।

 এভাবেই প্রথমে প্রশিক্ষিত জনে ও অস্ত্রে গেরিলা অপারেশনোপযোগী তৎপরতার প্রাথমিক ভিত্তি রচিত হবার পরই ঢাকায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী গেরিলা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। গেরিলাদের আনা অস্ত্রগুলি সম্বন্ধে আমার পূর্বধারণা বিশেষ কিছু ছিল না। তাই আমার বাসায় নিয়ে আসার পর আমরা সেগুলির ব্যবহার সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমার কাছে সবচেয়ে মারাত্মক ঠেকেছিল এক্সপ্লোসিভগুলি, সেগুলি ছুঁয়ে দেখতে সাহসে কুলোচ্ছিল না, ছিল টাইম পেন্সিল বোম, ইগনেটিং অয়ার, ডেটোনেটর ইত্যাদি বিধ্বংসী ধরনের নানা ডিভাইস।

 অস্ত্রগুলি আনার পরদিনও আমরা সেগুলি নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি। তারপর উলফত, মায়া, জুয়েল আমরা সবাই মিলে কিভাবে কোথায় অপারেশন চালানো যাবে এ নিয়ে পরিকল্পনা করি। মায়াকে ২ নং সেক্টর থেকে এই দলের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল, এবং সেই জন্য তার দল পরিচিত ছিল মায়া ক্র্যাক প্লাটুন বলে। ঢাকা শহরে আমার বিশেষ অবস্থানগত কারণে- যা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মায়া পরিকল্পিত অপারেশনগুলিতে স্থানীয়ভাবে আমার নেতৃত্ব ভূমিকা কামনা করে এবং আমি তার আগস্ট মাসে পাক সামরিক জান্তার হাতে ধরা পড়ার পূর্বমুহূর্তে পর্যন্ত সানন্দে পালন করেছিলাম। গেরিলাদের ঢাকায় নিজ বাসগৃহে থাকার সমূহ অসুবিধা ছিল। গেরিলা যুদ্ধের জন্য অত্যাবশ্যক গণভিত্তি হিসাবে আমি তাদের নিরাপদ শেলটারের ব্যবস্থা করেছিলাম, তাদের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় পোশাক পরিচ্ছদ সরবরাহ করেছিলাম- সমস্তই এককভাবে এবং তাদের অপারেশন সংগঠন ও পরিচালনায় সাহায্য করেছিলাম প্রত্যক্ষভাবে।

 ২ নং সেক্টরের অধিনায়ক তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং গেরিলা প্রশিক্ষক মেজর, এ, টি এম হায়দার প্রায়শঃই গোপনে কুরিয়ার মারফৎ আমাকে চিঠিপত্র পাঠাতেন ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা এবং গেরিলাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। এক পর্যায়ে মুজিবনগর থেকে জেনারেল এম, এ, জি ওসমানীরও নির্দেশ সম্বলিত চিঠি পেয়েছিলাম।