পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৮৩

ঢাকায় পরিকল্পিত গেরিলা অপারেশন চলাকালীন সময়ে আমরা দ্বিতীয় দফা আরও কিছু অস্ত্রশস্ত্র পাই। এগুলো ছিল বিশেষ ধরনের এবং গেরিলাদের ভাষায় ছিল ঢাকা শহরকে কাঁপিয়ে তোলার মতো। অস্ত্রগুলি এসে পৌঁছেছিল স্বামীবাগের পুরনো একতলা একটি বাসায়, সেগুলি ছিল বয়স্কা এক মহিলার হেফাজতে। 'আমি দু'জন গেরিলা যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্রগুলো আনতে যাই। গেরিলা দু'জন উক্ত মহিলার পরিচিত থাকায় তিনি সন্দেহমুক্ত হয়ে দ্রুত অস্ত্রগুলো আমার হাতে তুলে দেন। একটি সুটকেসে ও একটি বস্তায় সেগুলি ভর্তি ছিল। অস্ত্রগুলো বেশ ভারী থাকায় সুটকেসের তলা ফেটে গিয়েছিল, এ নিয়ে মহিলা বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। অস্ত্রগুলি নিয়ে আমরা দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাই, এবং সেটি আমার অফিসেই। খোদ ঢাকা শহরই ছিল আমাদের এরিয়া অব গেরিলা অপারেশন, অস্ত্র প্রয়োগের কলাকৌশল রপ্ত করারও গোপন কেন্দ্র ছিল আমার প্লাস্টিক নিওন সাইন কারখানা ছোট্ট অফিসগৃহে- কারখানার ভারী ভারী হাতুড়ি, শাবল, কোদাল সমবায়ে লোহার কাজকর্মের দৈনন্দিন ধাতব শব্দরাজির আড়ালে। এসব নতুন পরীক্ষিত অস্ত্রগুলির মধ্যে ছিল বেশকিছু হ্যাণ্ড গ্রেনেড, ফসফরাস গ্রেনেড, এম-কে ১৪ মাইন, এম-কে ১৬ মাইন এবং ১৬ মাইনের ক্যাবলসহ একখানা রীল।

 উল্লেখ্য, আমাদের গেরিলা তৎপরতার মান ক্রমশঃ যতই উন্নত হয়ে উঠছিল ততই আমরা সেক্টর কমাণ্ডারদের নির্দেশ সমেত অনেক নতুন নতুন অস্ত্রও পাচ্ছিলাম। এ প্রসঙ্গে একজন অত্যন্ত সাহসী গেরিলা- আবু বকরের নাম মনে পড়ছে, গুলশান ২য় মার্কেটের পেছনে তার বাসা ছিল। সে মাঝে মাঝেই প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসতো এবং তার মারফত আরও কয়েকজন তরুণ গেরিলার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল, যাদের মধ্যে দু'জন স্বৈরাচারী আইয়ুব আমলের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনেম খানের সাড়াজাগানো হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেছিল। এরা ছিল খুবই স্মার্ট এবং সুপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বিশেষ করে আবু বকরের পায়ের আড়ালে প্লাস্টিকে মোড়ানো ভাঁজ করা স্টেন বহনের কৌশল ছিল খুবই চমকপ্রদ। চেকিংয়ে দেহতল্লাশীর সময় তার হদিসই মিলত না। মাহবুব সালাম ও নীলুর গুলশানের বাসায়ও এক্সপ্লোসিভ রাখা হতো। নীলু ও শাহজাহান নামের একটি ছেলে দু'টো অপারেশন করেছিল, যদিও তা সফল হয়নি। এরা ছিল আমার রিক্রুট। এদের অপারেশনে আমি নিজেও জড়িত ছিলাম।

 অপারেশনকালে আমাদের সাথে আরও কিছু ছেলে যোগ দেয়। তাদের মধ্যে মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আমজাদ আহমেদ চৌধুরীর ছোট ভাই আনোয়ার চৌধুরী ছিল অন্যতম। মিঃ জামানের নাভানা ওয়ার্কশপে গোপনে তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ঘটে। আনোয়ার চৌধুরী অপারেশনে বিশেষ করে গাড়ির ব্যবস্থা করার ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিল।

 দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, বিশ্ববাসীর কাছে দখলদার বাহিনীর এই দাবী চূর্ণ করার উদ্দেশ্যে আমরা প্রথম প্রচেষ্টা নিই ঢাকা শহরে সন্ত্রাস সৃষ্টির। সংশ্লিষ্ট সেক্টর কমাণ্ডারদেরও নির্দেশ ছিল এটা। এ ব্যাপারে যা কিছু প্লান প্রোগ্রাম তার সবই হতো আমার বাসার ড্রয়িং রুমে। সন্ধ্যার অন্ধকার ছিল আমাদের অপারেশনগুলি উপযুক্ত সময়। অপারেশনগুলি ছিল কমাণ্ডার খালেদ মোশাররফের ভাষায়ঃ “সিটি টেররাইজিং অপারেশনস'।

 মুক্তিবাহিনীর সুদৃপ্ত অস্তিত্ব ঘোষণার জন্য আমরা মোহাম্মদপুরের অবাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকা থেকেই প্রথম যাত্রা শুরু করি। বিশ্বস্ত বাহন আমার টয়োটা করোলা, দলে হাফিজ ভাই, উলফত, গাজী বাপী এবং আমি। আগস্টের দিকে ঘটনা। আমরা যখন আইয়ুব (বর্তমানে আসাদ) গেটের কাছাকাছি, তখন মীরপুরের দিক থেকে একটি আর্মি কনভয় আসছিল। আমরা সেটা লক্ষ্য করি। আমাদের সাথে কিছু এম-কে মাইন-১৪ ছিল। পেট্রোল নেবার ছল করে কাছের পেট্রোল পাম্পে গাড়ি থামাই, এরই মধ্যে উলফত রাস্তায় খুব দ্রুত ক'টি মাইন পেতে দিল, কনভয় এগিয়ে আসার আগেই। কনভয়ের প্রথম দুটো গাড়ি নির্বিবাদেই পার হয়ে গেল, পরের গাড়ির বেলায় ঘটল পরম আকাঙ্খিত বিস্ফোরণটি। মাইনের আঘাতে গাড়ির চাকা প্রচণ্ড শব্দে বার্স্ট হয়ে গেল, চারিদিক নড়ে উঠল। আমরা ততোক্ষণে হাওয়া।