পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৮৪

 আসাদ গেটে সন্ত্রাসের কাণ্ডটি ঘটিয়ে ঐদিনই শিকার খুঁজতে টয়োটা করোলা চলে আসে হাইকোর্ট-ময়মনসিংহ রোড ক্রসিং-এর ট্রাফিক রাউণ্ডে- এখন যেখানে স্বাধীনতা উত্তর শিল্পকীতি জোড়া দোয়েল ডানা বিস্তার করে আছে। সেখানে বাপী আর উলফতের পাতা মাইনের শিকার হয় অবাঙ্গালী যাত্রীবাহী এক ডবল ডেকার বাস। এর পরদিন নর্থ-সাউথ রোডের ওপর চাংওয়াতে অপারেশনের প্ল্যান নেওয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ করে আর্মি চলে আসাতে অপারেশন হলো না। তবে রাস্তার উল্টো পাশে রাখা আর্মি অফিসারের জীপের চাকার নিচে এম-কে ১৪ মাইন রেখে আমরা দ্রুত সরে পড়ি। গাড়িতে ছিলাম আমরা মোট ৪ জন। স্বীয়ারিংয়ে আমি, বাকী ৩ জন ছিল উলফত, হাফিজ ও বাপী। আমরা সরে পড়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে প্লাস্টিক মাইন দারুণ আওয়াজে ফেটে গিয়ে জীপ দু'টির চাকা বিধ্বস্ত হয়।

 এভাবে আরো বেশ কিছু গেরিলা অপারেশন আমরা করি। এগুলি ছিল গ্যানিজ ও ভোগ ফ্যাশন বিপনিকেন্দ্র অপারেশন, গ্রীন রোডের মোড়ে পেট্রোল পাম্প অপারেশন- যাতে সায়েন্স ল্যাবরেটরীর রাস্তায় হাফিজের (পরবর্তী কালে শহীদ) বসানো এম-কে ১৬ মাইনের তোড়ে খানসেনাসহ একটি মিলিটারী জীপ উড়ে গিয়েছিল, কমলাপুর স্টেশন অপারেশন, টয়েনবি সার্কুলার রোডস্থ গভর্নর হাউসের পার্শ্ববর্তী পি-এন-ও (পাকিস্তান ন্যাশনাল ওয়েল বা দাউদ পেট্রোলিয়াম লিঃ) পেট্রোল পাম্প অপারেশন ইত্যাদি। মায়া ক্র্যাক প্লাটুনের এসব অভিযানে অংশ নিয়েছিল (গ্যানিজ ও ভোগ-এর অপারেশনে) মায়া, মানু এবং গাজী দস্তগীর। এরা একটি ৯০ সিসি হোণ্ডায় চেপে অপারেশনে যায়। সাথে ছিল একটি স্টেন, গোটা কয়েক গ্রেনেড-৩৬ ও ফসফরাস বোমা। কভারে ছিলাম টয়োটাতে চেপে আমি (সামাদ) উলফত ও জুয়েল (পরবর্তীকালে শহীদ)। পি-এনও পেট্রোল পাম্প অভিযানটি হয়েছিল একটু ভিন্ন কায়দায়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা এখানে হানা দিয়েছিল কালো মুখোশ পরে, শুধু চোখ দুটো বের করে রেখে। মুখোশগুলো সেলাই করে দিয়েছিলেন আমার স্ত্রী শাহীন বানু। পাম্পের অবাঙ্গালী কর্মচারীর ‘ফ্যাণ্টোমাস আগেয়া' বলে আর্ত চীৎকার করে পালিয়ে যায়। গেরিলা দল ১০ পাউণ্ড পিকে চার্জ লাগিয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায় অপারেশনের স্টেন হাতে ছিল গাজী দস্তগীর ও টুলু। পাম্প অফিস ঘরের পাহারায় ছিল নীলু। বিস্ফোরক চার্জ বসিয়েছিল মায়া। গাড়ির ড্রাইভিংয়ে ছিলাম আমি। এই ভক্স ওয়াগান গাড়িটি ছিল এয়ার ভাইস মার্শাল (তৎকালীন উইং কমাণ্ডার), কে, এম, আমিনুল ইসলামের। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সীমান্ত অতিক্রমের পূর্বে এই গাড়ি ও তার নিজের পিস্তলটি আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। এই গাড়িটি পাওয়ার স্টেশনসহ ঢাকার বিভিন্ন অপারেশনে আমাদের প্রভূত কাজে এসেছিল।

 কমলাপুর রেল স্টেশনের অপারেশনটি ছিল আমার, মায়া, দস্তগীর- সম্মিলিতভাবে এই তিনজনের একটি গ্রেনেড থ্রো-এর অপারেশন। গ্রেনেড দুটি ছিল আমার গাড়ির ডেস্ক বোর্ডে দুটি বৈদ্যুতিক বাল্বের মোড়কে ঢাকা, যাতে চেকিংয়ে পড়লে খানসেনাদের দৃষ্টিকে তা সহজেই প্রতারিত করতে পারে। প্রয়োজনীয় কভার দেওয়ার জন্য আমার গাড়ির পেছনের বনেটে বানানো, ঠিক সীটের মতো দেখতে, একটি চোরা পকেটে রাখতাম সর্ব সময়ের দুটো স্টেনগান।

 আমাদের এই অপারেশনগুলির উদ্দেশ্য ছিল হানাদার বাহিনী অধিকৃত খোদ ঢাকা নগরীতেই যে স্বাভাবিক অবস্থা আদৌ বিরাজ করছে না তা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া। আমরা এই প্রাথমিক উদ্দেশ্যে সফল হয়েছিলাম এবং আমাদের এই দুর্ধর্ষ অভিযানসমূহের প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতিতে অপরাহ্নকাল অতিক্রান্ত হতে না হতেই ঢাকা শহর জনশূন্য হয়ে পড়া ছিল তখনকার দিনে প্রায় রোজকার অবস্থা। তবে আমাদের যা কিছু অপারেশন হয়েছিল, তা হয়েছিল নতুন ঢাকা এলাকাতেই, পুরনো ঢাকায় আমাদের কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করতে পারিনি।

 অপারেশনের সমস্ত খবর আমি স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করে সেক্টরে পাঠিয়ে দিতাম। আমাদের এই প্রাথমিক গেরিলা মিশনগুলি সাফল্যের পরবর্তী পর্যায়ে মেজর অপারেশন চালানোর নির্দেশ পেতে থাকি। এই সময় আমরা জেনারেল ওসমানীর একখানি চিঠি পাই। তাঁর চিঠিতে ছিল অপারেশনের জন্য রেকি করা, অবজেকটিভ বা টার্গেট স্থির করা, এসকেপ রুট ঠিক রাখা এবং বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজে বের করা সংক্রান্ত মূল্যবান পরামর্শ।