পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৮৫

প্রাথমিক অভিযানগুলির সাফল্য আমাদের আরবান গেরিলা কার্যক্রমকে আরও বিকশিত করে তুলতে থাকে এবং উন্নত ফায়ার পাওয়ারসজ্জিত একটি আধুনিক সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থায় এনে দাঁড় করায়। আমাদের গেরিলা দলে ক্রমেই আরো নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেরা আসতে শুরু করে। এদের মধ্যে বদি (বদিউল আলম), আলম, স্বপনের কথা মনে পড়ছে। জন সমর্থনের ক্ষেত্রেও ক্রমশঃ প্রসারিত হতে শুরু করে। উলফতের চাচা সাংবাদিক আতাউস সামাদ, ফ্লাইট লেঃ হামিদুল্লাহকে সীমান্ত অতিক্রমে সাহায্যকারী পরিবারের টিকাটুলী হাটখোলার শাহাদাত চৌধুরী (বর্তমানে সাপ্তাহিক 'বিচিত্রার' ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) তার ছোট ভাই ফতে আলী, এবং তাদের কনিষ্ঠ আরেক ডাক্তার ভ্রাতা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। হাফিজ ভাইয়ের বাসায় আলতাফ মাহমুদের যাতায়াত ছিল, গেরিলা তৎপরতায় তাঁর সক্রিয় সমর্থন ছিল। সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র এক জায়গায় থাকলে সহসা তা জানাজানির পর যদি পুরো সম্ভারই শত্রুদের হাতে পড়ে যায় এই আশংকায় আলতাফ মাহমুদ সেগুলি বিভিন্ন স্থানে রাখার পরামর্শ দেন এবং তাঁর নিজের বাসায়ও তার কিছু নিয়ে রাখেন। গেরিলাদের সাথে তাঁর এই সংযোগ ও তাঁর বাসায় রক্ষিত এই অস্ত্র পাওয়ার জন্য পাকবাহিনী তাকে ক্যাণ্টনমেণ্টে ধরে নিয়ে যায় এবং অকথ্য নির্যাতন করে বাংলাদেশের এই প্রখ্যাত সুরকারকে হত্যা করে।

 গেরিলা কর্মকাণ্ডের ক্রম বিস্তৃতিতের পরবর্তী ধাপে মায়া ক্র্যাক প্লাটুন যে অপারেশনগুলি পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিশেষভাবে সেগুলি ছিল (১) ফার্মগেট অপারেশন (২) দুঃসাহসিক উলান পাওয়ার স্টেশন অপারেশন (৩) গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন (৪) ওয়াপদা পাওয়ার হাউস রেইড (৫) কাঁটাবন মসজিদের উত্তর পার্শ্বস্থ বৈদ্যুতিক স্টেশনে হামলা (৬) হোটেল ইণ্টারকনের বিস্ফোরণ ইত্যাদি।

 এ ছাড়া, এনারগা রকটে যোগে এমপি হোস্টেল আক্রমণও ছিল এই পর্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যাতে ব্রিগেডিয়ার বশরি, লেঃ কর্নেল হেজাজীর মতো পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররাও ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিল। এম-কে ১৬ মাইন সংস্থাপন করে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াসও এই সময়ের ব্যাপর। এগুলি সবই ছিল জুলাই-আগষ্ট মাসের ঘটনা।

 ফার্মগেট অপারেশন চালিয়েছিল মোট ৬ জন গেরিলা- আমি (ড্রাইভিংয়ে) জুয়েল, বদিউজ্জামান, আলম, পুলু ও স্বপন। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল আলমের হাতে একটি চাইনীজ এস, এম জি, বাকী সবাইয়ের হাতে স্টেনগান। একটি ফসফরাস গ্রেডে ও একটি গ্রেনেড-৩৬ জুয়েল ও পুলুর হাতে। অপারেশনটি মাত্র তিন মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়। অবশ্য তার পূর্বে কয়েক দফা রেকি করে অভিযানের পরিকল্পনা স্থির করা হয়। এ অপারেশনে মারা গিয়েছিল হানাদার বাহিনীর ৫ জন মিলিটারী পুলিশ ও তাদের সহযোগী ৬ জন রাজাকার। ঢাকা সেনানিবাস, অপারেশন হেড কোয়ার্টার, এম পি এ হোস্টেল এবং তৎকালীন দ্বিতীয় রাজধানী (বর্তমানে শেরে-বাংলা নগর) এলাকার কাছাকাছি ফার্মগেটে খান সেনাদের একটি বড় ধরনের কড়া চেকপোষ্টের ওপর গেরিলাদের এই দুঃসাহসিক হামলা বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। উলান অপারেশনেও এমনি ইমপ্যাক্ট সৃষ্টি হয়েছিল। এটি ছিল জুলাইয়ের শেষ পক্ষের ঘটনা। অপারেশনটি সংঘটিত হয় গাজী দস্তগীরের নেতৃত্ব। দলে ছিল জিয়া, নীলু, হাফিজ এবং অন্যান্য আরো কয়েকজন। এরা ক্ষিপ্রতার সাথে পাওয়ার স্টেশনে পাহারারত পুলিশদের অতি সহজেই পরাভূত করে ট্রান্সফর্মারটির মারাত্মক ক্ষতি সাধনে সমর্থ হয়েছিল। একই সময় রাত্রি নয়টার দিকে গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনটিও উড়িয়ে দেওয়া হয়। ক্র্যাক প্লাটুনের পুলু, সাইদ, জুয়েল, হানিফ ও বাশার আরেকটি দলে বিভক্ত হয়ে এই অপারেশন চালায়, নেতৃত্বে ছিল জুয়েল। গাড়ির ড্রাইভিংয়ে ছিলাম আমি। ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ অপারেশন করি মায়া, আমি, উলফত এ কয়জনে মিলে। কাঁটাবনের উত্তর পার্শ্বস্থ কেন্দ্রের ওপর হামলাটি চালিয়েছিল আলম, জিয়া, বদি চুল্লুর গাড়িতে করে

 বিশেষভাবে ঢাকার পাওয়ার স্টেশনগুলি মায়া ক্র্যাক প্লাটুনের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল এ উদ্দেশ্যে যে, এগুলিকে অকেজো করে দিতে পারলে শুধু ঢাকা নগরীই অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে না, বন্ধ হয়ে যাবে দখলদার বাহিনীর রেডিও, টিভির সমস্ত প্রচার ও তাদের কর্মপ্রবাহ। এসব বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার সম্পর্কিত খুঁটিনাটি তথ্য জুগিয়েছিলেন দু'জন প্রকৌশলী। এদের একজন ছিলেন ওয়াপদার বিদ্যুৎ সরবরাহ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী