পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৯০

হারাই। এরপর আমরা ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর সাথে প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করি। আমাদের ছেলেদের মধ্যে মানিক, আফতাব, আমজাদ, নেহাল, টিটো এবং মানিকসহ মোট ছয়জন বিভিন্ন সংঘর্ষে শহীদ হয়।

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন-৫

প্রতিবেদন[১] : শাহাদাত চৌধুরী

 নভেম্বরের প্রথম দিকে বিবিসির খবরে বলা হয়েছিল ঢাকা শহর ঘিরে রেখেছে ৮ হাজার মুক্তিবাহিনী। তাঁরা বিছিন্নভাবে গেরিলা তৎপরতা চালাচ্ছে, কিন্তু যে কোন সময় এক সঙ্গে শহরে প্রবেশ করবে।

 গেরিলা রণনীতিতে বেছে নিতে হয় শত্রুর দুর্বলতম অংশ। সেক্ষেত্রে শত্রুর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি রাজধানী শেষ লক্ষ্যস্থল হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকা শহরে যেসব আক্রমণ চালানো হয় তার উদ্দেশ্য সামরিক কৌশলগত আধিপত্য অর্জন ছিল না। উদ্দেশ্যটা ছিল মূলতঃ পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়া মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করছে, এবং সহজেই আঘাত হানছে শত্রুর সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যূহে

 এ সম্পর্কে খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন অধিনায়ক। শহরে যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। শত্রুকে শুধু জানিয়ে দাও তোমরা আছো। দুই নম্বর সেক্টর এবং 'কে' ফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল খালেদ মোশাররফ সব সময় বলতেন গেরিলাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে। একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার কয়েকটি দুঃসাহসিক গেরিলা প্লাণ্টুনকে প্রত্যাহার করা হয়। কারণ, এদের কিছু যোদ্ধা ধরা পড়েন শত্রুর হাতে। তখন কর্নেল খালেদ বলেছিলেন, কাউবয় এ্যাডভেঞ্চার গেরিলা যুদ্ধ নয়। গেরিলা যুদ্ধ বীরত্ব দেখাবার জন্য নয়।

 বিবিসির ভাষ্যকারের তথ্য নির্ভুল বলা যেত যদি তিনি গেরিলাদের সংখ্যাকে দ্বিগুণ। শহরকে ঘিরে থাকা গেরিলাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, যা-ই হোক, মাথা তুলবে না প্রয়োজন ছাড়া। ঢাকার পুরনো যে দলটাকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল তারাও নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে 'ক্র্যাক' নাম নিয়ে ঢাকার পাশেই ত্রিমোহনী, গোরানবাহিরদা অঞ্চলে ঘাঁটি করে। কর্নেল খালেদ আশা করতেন, নভেম্বর মাসে মেজর হায়দারকে দিয়ে ঢাকা শহরে মিরাকল দেখাবেন। সে জন্যেই মেজর হায়দার তার প্রিয় দলটাকে অনেকদিন ক্যাম্পে আটকে রেখেছিলেন। অক্টোবরে কর্নেল খালেদ আহত হলে পুরো সেক্টরের দায়িত্ব মেজর হায়দারের ওপর এসে যায়। তাই মেজর হায়দার নভেম্বর হায়দার নভেম্বর ঢাকা আসতে পারেননি।

 মে মাসে ঢাকা শহরে একটি গোপন কথা প্রবাদের মত লোকের মুখে মুখে ফিরত, ক্যাপ্টেন হায়দার আসছেন। কথাটা মেজর হায়দারকে জানানো হলে তার চোখে মুখে অদ্ভুত আনন্দ, প্রত্যয় দেখা যেত। বলতেন, আমি যাবো। কিন্তু তাঁর পক্ষে আসা সম্ভব ছিল না। কারণ, গেরিলা এ্যাকশনের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে ছেলেদের শিক্ষা দেয়া, ব্রিফ করা, গাড়ী করে বাংলাদেশের ভেতরে তাদের নামিয়ে দেয়া তাঁর দৈনন্দিন কর্মসূচী ছিল। তিনটার আগে ঘুমাতে পারতেন না।

 ২নং সেক্টরের বৈশিষ্ট্য ছিল তার নিজস্ব ট্রেনিং ক্যাম্প। ভারতের সঙ্গে চুক্তি হবার আগেই মেজর হায়দার কাঠালিয়াতে কুমিল্লার কিছু ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেন দালাল হত্যার জন্যে। ঘরের বিভীষণকে আগে শেষ করা প্রয়োজন। তারপর প্রথম ব্যাচের শিক্ষা দেয়া নবীনগরে, পরে মেলাঘরে। এদেরকে নিখুঁত গেরিলা হিসাবে তৈরীর জন্য নানাভাবে ট্রেনিং দেয়া হত। সুবিধে ছিল মেজর কমাণ্ডো বাহিনীর লোক।

 নভেম্বর মাস থেকেই ঢাকাকে ঘিরে গেরিলারা তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ‘মানিক গ্রুপ' সাভার অঞ্চলে আর এদিকে ‘ক্র্যাক'। ‘ক্র্যাক'রা এসেই বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়েছিল স্থানীয় পাঠশালায় যেখানে তাঁরা


  1. “দৈনিক বাংলা' ১ ডিসেম্বর ১৯৭২-এ প্রকাশিত 'মানুষের সঙ্গে মিশে যুদ্ধ করেছে গেরিলারা' শীর্ষক প্রতিবেদনের অংশ।