পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৭

 ভোর হওয়ার সাথে সাথে ট্যাঙ্কের গর্জন বেশী বাড়তে থাকে। ব্যারাকের উপর ট্যাঙ্কের গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। চারিদিকে পাহাড়ের উপর তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা পড়তে থাকে আর চতুর্দিকে বাঙ্গালী আহত সৈন্যদের গোংড়ানি ও আর্তনাদ পুরো এলাকায় এক বিভীষিকা এবং বীভৎসতা সৃষ্টি করেছিলো। তারপর দেখা গেল বহু বাঙ্গালী সৈন্যকে চতুর্দিক থেকে বেয়নেটের মুখে ধরে আনা হচ্ছে আর তাদেরকে ই-বি-আর-সি স্কুল কক্ষে ঢুকানো হচ্ছে। একদল ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে আর কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে বড় লাঠি নিয়ে ঢুকতে দেখি। আর সাথে সাথে তাদের বেদম মারপিট শুরু হয়ে যায়। তারা যখন ভীষণ আর্তনাদ শুরু করে তখন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাইরে আসে। বাহির থেকে ভেতরে দু-তিন রাউণ্ড গুলি ছোড়ার সাথে সাথে আর্তনাদ বন্ধ হয়ে যায়।

 আমার সামনে যে সব সিপাহীকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছিলো। তাদেরকে বাঁধা হয়। ভোর সাতটার দিকে একজন সুবেদার এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে “খাজানা (ট্রেজারী) কিধার হায়।” আমি আঙ্গুল দিয়ে দেখাবার সাথে সাথে সুবেদার আমার উপর স্টেনগান উঠিয়ে বলে, ছহি ছহি বাতাও কিধার হায়। কারন দুদিন আগে দেড় লাখ টাকা সিপাহীদের বেতন বাবদ ঢাকা থেকে ই-বি-আর সিতে পাঠানো হয়েছিল।

 কিছুক্ষণের মধ্যে সুবেদার একটি হাবিলদারকে নির্দেশ করে বলে, সাব কো ভী বাঁধো। হাবিলদার একটা রশি নিয়ে আসে। আমি দুই হাত পিছু করার সাথে সাথে সে আমাকে বেশ শক্তভাবে বেঁধে ফেলে। আমি বলি, ওস্তাদ বহুত জেয়াদা টাইট হায়, সে বলে সাব আপকা বাজু বহুত মোটা হায়। আমি হাসতে হাসতে বলি, হামতো গামা নেহী হায়। যাক সে আমার বাঁধন একটু শিথিল করে, কিছুক্ষণ পর আমার কমাণ্ডো প্রহরীটি বাঁধন খুলে নামেমাত্র বেঁধে দেয়।

 এই সময় আমাদের সুবেদার মেজর রুহুল আমিন, নায়ক সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার লুৎফুলকেও বেঁধে আনা হয়।

 কিছুক্ষণ পরে সুবেদার রহমানকে বেঁধে আনা হয়। তাকে আমি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখলাম। একটা গুলি তার পেটে ঢুকে অপর দিকে বের হয়ে যায়। রক্ত পড়ছিল। তাকেও বেঁধে রাখা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে চা, পরাটা, হালুয়া, খাচ্ছিল। কমাণ্ডো প্রহরীটি আমার জন্য চা আনতে যাওয়াতে তাকে অপমান করা হয়। সে এসে বলে সময় সবকিছু করে।

 আমার সামনের লোকদেরকে খালি চা দেওয়া হয়। তার বিষ মনে করে ক্ষেতে ইতস্ততঃ করে। আমি একটু মুখে নিয়ে বলি, খেয়ে ফেল, কোন অসুবিধে হবে না। কিন্তু সুবেদার মেজর ও নায়েক সুবেদার লুৎফর রহমান তাতেও চা স্পর্শ করলেন না।

 পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ই-বি-আর-সি পাহাড়ের নিচে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় আর পাহাড়ের উপর ৩” মর্টার আর ট্যাংক দিয়ে অনবরত গোলাবর্ষন করতে থাকে। উপর থেকে প্রত্যুত্তরে দু-চারটি গুলিও আসতে থাকে।

 ২৬শে মার্চ বেলা এগারটার দিকে আমাদের কোয়ার্টার গার্ড থেকে পলাতক একটি বাঙ্গালী সৈন্য ইবি-আর সি ফুটবল মাঠের ড্রেন থেকে অকস্মাৎ তিনটি গুলি ছুড়লে প্রায় ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। প্রায় ১২/১৩ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। তারপর সে পালাতে শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত সৈন্যটি তাদের গুলিতে মৃত্যুবরণ করে।

 ২৬শে মার্চ ভোর ৭টার দিকে পাক সৈন্যরা যেসব লোকদেরকে রাত্রে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছিলো তাদেরকে একটি ট্রাকে ভর্তি করতে দেখতে পাই। আমার সামনে দিয়েও শ’খানেকেরও উপর লাশ নিয়ে যেতে দেখতে