পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৫

নামে পাঞ্জাবীদের অস্ত্রের ফায়ারিং পিন অকেজো করে দিয়েছে এবং তুমিও তোমার উইং-এ তাই করো। আমি রাজী হলাম। আমাকে তিনি কোড ওয়ার্ড দিলেন, “ব্রিং সাম উড ফর মি”- অর্থ হলো চট্টগ্রামে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমাকেও বিদ্রোহ শুরু করতে হবে। এবং সমস্ত অবাঙ্গালীদের বন্দী করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে মিলতে হবে।

 ২৪শে মার্চ খুব ভোরে আমি কাপ্তাই চলে গেলাম। আমার উইং-এ সুবেদার মেজর ছিল (বাঙ্গালী) নজমুল হক। সুবেদার মেজর আমাকে সব খবরাখবর এনে দিত। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে অবাঙ্গালী এন-সিও এবং জে-সি-ওরা রাতে গোপনে মেজর পীর মহম্মাদের (উইং কমাণ্ডার) বাসাতে সলাপরামর্শ করতো। আমি সবসময় সতর্ক থাকতাম এবং বুঝতে পারতাম উইং কমাণ্ডার এবং অবাঙ্গালীদের মনে আক্রমাণাত্মক প্রস্তুতি চলছে। আমি ভিআইপি রেস্ট হাউসে থাকতাম। ২৪শে মার্চ সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন ফারুক বান্দরবন থেকে উইং হেডকোয়ার্টারে আসে। ক্যাপ্টেন জায়দী আমার অনুমতি নিয়ে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় কাপ্তাইতে আসেন। ক্যাপ্টেন ফারুক এবং ক্যাপ্টেন জায়দী আমার রুমে জায়গা নিলেন। আমরা তিনজন কথাবর্তা বলে রাত ৯-৩০ থেকে ১০টার দিকে ঘুমতে যাই। এমন সময় আমার অর্ডারলি দরজা ধাক্কা দেয় এবং আমার টেলিফোনের কথা বলে। আমি টেলিফোনে যেয়ে শুনলাম যে লাইন কেটে গেছে। তবে অপারেটর বলল, ক্যাপ্টেন রফিক কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমি রুমে ফিরে যাই এবং মিনিট দশেক পর আবার টেলিফোন আসে। টেলিফোন ধরে জানলাম এম, আর, সিদ্দিকী। জনাব সিদ্দিকী বলেন, ২০-বালুচ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে আক্রমণ করেছে। শহরে খুব গোলমাল, আপনি বিদ্রোহ করেন এবং চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন। আমি রফিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। তিনি বললেন, “রফিক যুদ্ধ করছে, সে এখানে নাই। এরপর আবার টেলিফোন পেলাম, করেছেন জনাব এম, আর, সিদ্দিকী। জনাব সিদ্দিকী বলেন, “রফিক যুদ্ধ ময়দানে তবে একটি কোড ওয়ার্ড পাঠাতে বলেছেন, সেটি হলো, ব্রিং সাম উড ফর মি।” তখন আমি অবস্থাটা বুঝলাম। তখনই আমার রুমে এসে পোশাক পরি এবং সিদ্ধান্ত নিই অবাঙ্গালীদের নিরস্ত্র করবো এবং চট্টগ্রামে রওয়ানা হব। পোষাক পড়ার সময় অবাঙ্গালী অফিসার জেগে যায় এবং তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে আমি পোশাক ক্যান পরছি। “লাইনে কিছু গোলমাল, এখনই ফিরে আসবো, তোমরা ঘুমাও”- এই কথা বলেই আমি চলে যাই। গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় এক অবাঙ্গালী এন-সিও আমার দিকে আসে, এবং বলে স্যার, লাইনে গোলমাল। তখন এনসিওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আমি লাইনে যাই। লাইনে পৌঁছে আমি সুবেদার মেজরকে ডাকি এবং সমস্ত কথা বলি। তাকে বলি, “কোতে চাবি নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। বাঁশী বাজালে কোত খুলে দেবেন।” ঐ রাতে গার্ড কমাণ্ডার ছিলো একজন পাঞ্জাবী। তাকে ডেকে আমাদের দোতালায় সমস্ত এন-সিকে ডাকতে বললাম। আমার সাথের এনসিওকে তার আগেই উপরে পাঠিয়েছিলাম। গার্ড কমাণ্ডার উপর তলা থেকে নীচে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আমি বন্ধি করি এবং অস্ত্র কেড়ে নেই। আমার কথামত কোয়ার্টার গার্ডের বাঙ্গালী সৈনিকরা সঙ্গে সঙ্গে দোতলায় সিঁড়ির মুখে পজিশন নিতে থাকে। হুইসেল দেই, সমস্ত বাঙ্গালী সৈনিকদের উপর হতে নিচে নেমে আসতে বলি এবং অবাঙ্গালীদের উপরে থাকতে বলি। কোন অবাঙ্গালী নামার চেষ্টা করলে গুলি করার হুকুম দেই। বাঙ্গালীরা প্রস্তুত ছিল, তাই হুইসেলের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বাঙ্গালীরা নীচে নেমে আসে। কোত খুলে দেওয়া হয় এবং সকলের হাতে অস্ত্র-গোলাবারুদ তুলে দেওয়া হয়। আমি তখন উইং কমাণ্ডার মেজর পীর মহাম্মাদকে নিরস্ত্র করতে গেলাম। কাপ্তাইতে তখন কতগুলো পয়েণ্ট ছিল, যে পয়েণ্টে আমাদের ই-পি আর বাহিনীর ৪/৫ জন পাহারায় থাকতো। উইং কমাণ্ডারের বাসার সামনেই একটা পয়েণ্ট ছিল। সে পয়েণ্টের গার্ড ছিল অবাঙ্গালী। আমি তখন পয়েণ্টের গার্ডটিকে নিরস্ত্র করি এবং তারপর মেজর পীর মহাম্মদের বাসায় যাই। মেজর পীর মহাম্মদ তখন ঘুমাচ্ছিলেন। ডাকাডাকিতে উঠলেন এবং তিনি আমাকে পোষাক পড়া দেখে ঘাবড়ে গেলেন। তিনি আসলে বললাম, “আপনি বন্দী। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আমি উইং-এর দায়িত্ব নিয়েছি।” মেজর পীর মহাম্মাদ অস্ত্র ধরার চেষ্টা করলেন। আমি হুঁশিয়ার করে দেই, “অগ্রসর হলে মৃত্যু।” তাকে বললাম, “ঘরে থাকেন, কোন অসুবিধা হবে না আপনার।” এই বলে বাইরে গার্ড রেখে আবার রুমের দিকে যাই। রুমে পৌঁছে দেখলাম ক্যাপ্টেনদ্বয় উঠে বসেছে। তাদেরকে বললাম, “তোমরা বন্দী। এদেশ স্বাধীন।” পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন জায়দী উঠবার চেষ্টা করে, কিন্তু তার আগেই তাঁকে বন্দী করে