পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৭

 বেতার-কেন্দ্রটি খোলা হয়েছিল চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। ২৮শে মার্চ সকালে কালুরঘাটে মেজর জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে চট্টগ্রাম শহরে ফেলার পথে আমি প্রথমবারের মতো বেতার কেন্দ্রটিতে প্রবেশ করি। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঐ বেতার কেন্দ্রে কর্মরত স্টাফের সাথে আমার পরিচয় হয়। সেখানে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লেফটেন্যাণ্ট শমশেরের সাথেও আমার দেখা হলো লেফটেন্যাণ্ট শমশের সে সময়ে বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের লিখিত ভাষণ বারবার প্রচার করছিলেন।

 সেদিন পশ্চিম কমোডোর মমতাজের বাসা আক্রমণের পর আমি বেতার কেন্দ্রে ফিরে আসি এবং লেফটেন্যাণ্ট শমশেরের স্থলাভিষিক্ত হই। মেজর জিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী লেফটেন্যাণ্ট শমশের সে সময়ে কালুরঘাটে ফিরে যান।

 বেতার কেন্দ্রে অবস্থানকালে সেখানে আমার কাজ ছিল ঐ বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের চারদিকে মোতায়েন প্রতিরক্ষা বাহিনীকে কমাণ্ড করা ঐ কেন্দ্রের গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং বেতার কেন্দ্র প্রচারিতব্য সংবাদ, বুলেটিন ও নানা কথিকা পড়ে সে-সব এ্যাপ্রুভ করে দেওয়া। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বেতার-কেন্দ্রে থাকাকালীন আমাদের সাথে যারা কাজ করতেন তাদের বেতার কেন্দ্রের অভ্যন্তরে আসা যাওয়ার অনুমতি দিয়ে আমি ৭টি 'পাস' ইস্যু করেছিলাম। প্রথমে ৬টি এবং পরে ১টি পাস ইস্যু করা হয়েছিল। মেজর জিয়ার নির্দেশ ছিল কোন সংবাদ বা কথিকা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচার করার আগে অবশ্যই তা কোন অফিসারকে পড়ে চেক করে দিতে হবে। লেফটেন্যাণ্ট শমশের বেতার কেন্দ্র থেকে কালুরঘাট চলে যাবার সময় মেজর জিয়ার এই নির্দেশের কথা আমাকে বলে গিয়েছিলেন। সে সময় বেতার কেন্দ্র থেকে আমি যেসব সংবাদ এবং কথিকা পাঠ করেছি তার সবগুলোতেই আমি আমার ইনিশিয়াল দিয়েছি। বলা বাহুল্য, এসব কাজ করার সময় আমার মনে এক অসাধারণ বিপ্লবী চেতনার জন্ম হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, সে সময় আরব জাহানের প্রখ্যাত গেরিলা নেতা ইয়াসের আরাফাতের কর্মধারা ও জীবন-চেতনা আমাকে অনুপ্রানিত করে তুলেছিল। তাঁর কথা তখন আমার বারবারই মনে পড়তো, মনে পড়তো তাঁর বিপ্লবী-সংস্থা 'প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রণ্ট'-এর কথাও। মনে আছে, একটি কথিকায় লেখক-প্রদত্ত নামটি কেটে দিয়ে তার ওপর আমি লাল কালিতে আমাদের সংগ্রামী-সংস্থার নাম দিয়েছিলাম 'বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রণ্ট'। পরবর্তীকালে সাংবাদিকরা এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ‘মুক্তিফৌজ'।

 ২৮শে মার্চ সন্ধ্যায় লেফটেন্যাণ্ট শমশের ও আমি অনেক্ষণ আলাপ আলোচনার পর ব্লাক আউট ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিই। সে অনুসারে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ব্লাক আউট পালনের ঘোষণাও প্রচারিত হয়। বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা অনুযায়ী যথারীতি ব্লাক আউট পালিতও হয়েছিল। বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত আরেকটি গুরুত্বপুর্ন নির্দেশে সবাইকে নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে ক্যাপ্টেন মুহসিন, ক্যাপ্টেন মুখলেস, ক্যাপ্টেন ইনাম, ক্যাপ্টেন ওয়ালী, ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া ও অন্যান্যের কাছে রিপোর্ট করার আহবান জানানো হয়েছিল। অবশ্য এই ঘোষণায় কোনো জায়গার নাম উল্লেখিত হয়নি।

 আরেকটি গুরুত্বপূর্ন ঘোষণায় বলা হয়েছিলঃ 'নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লালদীঘির ময়দানে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে রিপোর্ট করুন। এই ঘোষনায় রিপোর্ট করার স্থান হিসাবে লালদীঘির ময়দান এর উল্লেখ ছিল কারণ ২৯শে মার্চ সকালে দেখা গেল যে চট্টগ্রাম কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই রোড ধরে হাজার হাজার লোক নিজ নিজ বাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ২৮-২৯শে মার্চ রাতে পি, এন, এস, জাহাঙ্গীর যুদ্ধজাহাজ থেকে পাঞ্জাবীরা চট্টগ্রাম শহরে অত্যাধিক শেলিং করেছিল। শেলিং এর দরুন কয়েক জায়গায় আগুন ধরে যায়। আগুনের ফুলকিতে মনে হয়েছিলো চট্টগ্রাম শহরে বুঝি পাইকারী ধ্বংসলীলা চলছে। এ অবস্থা দেখে বেসামরিক লোকেরা যার হাতে যে বন্দুক বা অন্য অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে প্রাণভয়ে গ্রামের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে তখন নেতৃত্ব দেওয়ার মত কেউ ছিল না, তাই তারা অসংঘবদ্ধভাবে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছিল। ঐসব লোকদের আবার একত্রিত করে পুনর্গঠিত করার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবী বেতার থেকে অস্ত্র নিয়ে লোকদের আবার একত্রিত করে