পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৯

 আগেই খবর পেয়েছিলাম, শত্রুবাহিনী ফেনীর কাছে শুভপুরের ব্রীজ পেরিয়ে এগিয়ে এসেছে। অতএব, যত দ্রুত তাদের অগ্রগতি প্রতিহত করা যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমার কথামত আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী ৫টি সাধারণ পরিবহণ ট্রাক এনে হাজির করলেন। তখন আমার সৈন্যবাহিনী ও জনসাধারণের প্রত্যেকেই যেন একটা যুদ্ধাংদেহী ভাব। তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেন অনেকদিনের পুঞ্জীভূত বেদনা বঞ্চনা, ক্ষোভ, আক্রোশ বিদ্রোহের আগুনে ফুঁসে উঠেছে এবং তা দুর্জয় সংগ্রামের মাধ্যমেই যেন স্ফুরিত হতে চায়। চবিবশ বছরের পাকিস্তানী বুর্জোয়াদের শাসন শোষণ ও অত্যাচার-উৎপীড়নের জগদ্দল পাথরকে টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ফেলতে আজ সবাই যেন বদ্ধপরিকর।

 আমি আমার ক্ষুদ্র দলের ১০২ জন যোদ্ধাকে ৪টি ট্রাকে উঠালাম এবং বাকি ট্রাকটিতে কয়েকটি গুলির বাক্স উঠিয়ে দিলাম। আমি নিজে একটি মোটর সাইকেলে চড়ে সবার আগে চললাম। উদ্দেশ্যঃ এগোনোর সাথে সাথে পথের দুপাশে এমন একটি উপযুক্ত স্থান খুঁজে নেওয়া যেখান থেকে শত্রুর উপর সাফল্যের সাথে প্রচণ্ড আঘাত হানা যায়। শুভপুরে সেদিন আমাদের যাত্রাপথের দৃশ্য অবিস্মরণীয়। রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমিয়েছে। তাদের মধ্যে কল-কারখানার শ্রমিকই বেশী। মুখে তাদের নানান শ্লোগান। হাজার কণ্ঠের সেই শ্লোগান আকাশ বাতাশ মুখরিত করে তুলেছিল। গত রাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া বর্বর বাহিনী কর্তৃক অতর্কিত আক্রমন, নির্মম হত্যা, পাশবিক অত্যাচার, বিশেষত: বেঙ্গল রেজিমেণ্টের জওয়ানদেরকে পাশবিকভাবে হত্যা করার খবর এরই মধ্যে প্রতিটি মানুষের কানে পৌঁছে গেছে। যে কোনোভাবে এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত। সুতরাং যখনই তারা দেখতে পেল খাকি পোশাক পরা বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ইপিআর এর জওয়ানরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মুহুর্মুহু তার শ্লোগান দিতে লাগল। জয় বাংলা, বেঙ্গল রেজিমেণ্ট জিন্দাবাদ, ই-পি-আর জিন্দাবাদ। এদিকে তাদের কেউ কেউ সৈন্যদেরকে কি দিয়ে এবং কিভাবে সাহায্য করতে পারবে তাই নিয়ে মহাব্যস্ত।

 আমাদের সৈন্য বোঝাই ট্রাকগুলো তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। এমন সময় একজন বুড়ো লোক তার পথের পাশের দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিল। বললোঃ স্যার আমি গরীব মানুষ কিছু দেওয়ার মত আমার ক্ষমতা নাই। এই নিন আমার দোকানের সিগারেট (সিগারেট ৩ কার্টুন ছিল); আপনার জওয়ানদের মধ্যে বিলিয়ে দিন। বৃদ্ধের এই সহানুভূতি ও আন্তরিকতায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠল। আর একজন একটি ট্রাকে করে প্রায় এক ড্রাম কোকাকোলা নিয়ে এল। কেউ কেউ খাদ্যসামগ্রীও নিয়ে এলো।

 আন্তরিকতা ও ভালবাসার সেই উপহার আমাদের মনকে আনন্দে উদ্বেল করে তুলেছিল। কেমন করে কি ভাবে তারা সেসব জিনিস যে সেদিন সংগ্রহ করেছিলেন তা ভাবলে আজও বিস্মিত হই।

 সন্ধ্যা তখন ৬টা। আমরা কুমিরায় পৌঁছে গেলাম। শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্য স্থানটি খুবই উপযুক্ত বিবেচিত হল। পথের ডাইনে পাহাড় এবং বামদিকে আধ মাইল দুরে সমুদ্র। শত্রুর ডানে এবং বামে প্রতিবন্ধকতা আছে এবং শত্রুকে এগুতে হলে পাকা রাস্তা দিয়েই আসতে হবে। তাই সেখানেই পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যেখানে পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তার পিছনে একটি খাল ছিল। ঐ খাল থেকে ৫০০/৬০০ গজ সামনে অর্থাৎ উত্তর দিকে আমি পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। খালটি একটি পদাতিক বাহিনীর জন্য তেমন একটা বাধা নয়। তবু এটা পিছনেই রাখলাম। উদ্দেশ্য ছিল যদি বর্তমান পজিশন শত্রু আমাদেরকে ছাড়তে বাধ্য করে তখন খালের পারে পজিশন নিতে পারব। এটা ছিল আমার বিকল্প পরিকল্পনা। জমিনের স্বরুপ দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিকল্পনা তৈরি করে নিলাম। আমার তিনজন প্লাটুন কমাণ্ডারকে ডেকে খুব সংক্ষেপে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম এবং নিজ নিজ স্থানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দিলাম। আমার নির্দেশ অনুযায়ী এইচ-এম-জি'টা ডানে পাশে পাহাড়ের ঢালুতে ফিট করা হলো। স্বয়ং ই-পি-আর