পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৬০

জাফর ঢাকার কোন সংবাদ এসেছে কিনা জানার জন্য আওয়ামী লীগ অফিসে দিকে গেলেন। আমি আমার এক বন্ধু ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনকে নিয়ে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আগেই রাতের খাবার খেয়ে নেয়ার জন্য বাসার ভিতরে গেলাম। খাওয়া কেবল শুরু করেছি, এমন সময় একজন আওয়ামী লীগ কর্মীসহ ডাঃ জাফর আবার ফিরে এলেন। রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিট।

 “মনে হচ্ছে আলোচনা ব্যার্থ হয়েছে। প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া গোপনে করাচী চলে গেছেন বলে শোনা যাচ্ছে ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্যাংক নিয়ে শহরের দিকে বেরিয়ে পড়েছে বলে খবর এসেছে।” তারা দু'জনই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় এতো উত্তেজিত ছিলো যে তাদের মুখ দিয়ে যেন কথা সরছিলো না।

 “আপনি কি সত্যি সংবাদ বলছেন?” তবু আমি ডাঃ জাফরকে জিজ্ঞেস করলাম।

 “হ্যাঁ। ঢাকা থেকেই আমরা এ খবর পেয়েছি। খবর পেয়েই আমাদের দল জনাব সিদ্দিকীর বাসায় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে জনাব সিদ্দিকী আমাদেরকে অবিলম্বে আপনাকে ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে বলেছেন এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আপনাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এতগুলো কথা বলে উভয়ে একটু থামলেন এবং গভীর আশা নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তাদের দু'জনকেই বিষন্ন দেখাচ্ছিল। আমি শুনতে পেলাম, কে যেন খুব নিচু গলায় বলল, “এবার আপনার পালা।”

 তখনও আমরা হাত ভাতের থালায়। মুহুর্তের জন্য আমি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। ওদিকে আগ্রহী আগন্তুকদের স্থির দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ।

 সেনাবাহিনী ট্যাংক নিয়ে শহরের দিকে বেরিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই তারা ভয়ানক কিছু ঘটাবে। সব চাইতে খারাপ কিছুর কথাই এখন আমাদের ভাবা উচিত। ৩রা মার্চ থেকেই ওরা নির্বিচারে বাঙ্গালীদের হত্যা করেছে শুধু ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম পোর্টে ২০ জনেরও বেশী লোক নিহত হয়েছে। আরো খবর পেয়েছিলাম বাংলাদেশের সর্বত্রই ওদের হত্যাকাণ্ড চলছে- ঢাকা, খুলনা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহীসহ আরো অনেক জায়গায় গুলি চলেছে। ২৫শে মার্চ সন্ধায়ও এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম ই-পি-আর- এর দুটি ওয়্যারলেস সেটই ঢাকার পিলখানার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলো না। এমন কোন দিন ঘটেনি। সন্দেহ আগে আগে থেকেই গভীরতর হয়ে উঠেছিল।

 এসব দ্রুত আমার মানসপটে ভেবে উঠলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থেকে জেনেছি, ওদেরকে কোন জায়গায় একবার লেলিয়ে দেয়া হলে হেন নৃশংসতা নেই যা ওরা করতে পারে না। ইয়াহিয়ার আকস্মিক ঢাকা ত্যাগ, আলোচনা ব্যার্থ হওয়া এবং ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে সেনাবাহিনীর বের হওয়া- সবকিছু মিলিয়ে একটা বেপরোয়া হত্যালীলার সুস্পষ্ট আভাস পাচ্ছিলাম। আরো আশংকা করছিলাম, সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালী সৈন্যরাও ওদের হাত থেকে নিস্তার পাবে না।

 এ সময় নিজের ভেতর থেকেই আমি যেন এক অলৌকিক সাহস অনুভব করলাম। মনে হলো আমার ভেতর থেকে কে যেন আমাকে বলছে আমার নিজের জীবন এবং আমাদের অন্যান্যের জীবন রক্ষার জন্য এ পশুশক্তির বিরুদ্ধে অবশ্যই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এর পর আমি 'হয় স্বাধীনতা অর্জন, না হয় ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে মৃত্যু' এ ধরনের এক চরম সিদ্ধান্ত নিলাম। ডাঃ জাফরকে বললামঃ “আমাদের ষোলশহর এবং ক্যাণ্টনমেণ্টে গিয়ে বাঙ্গালী সৈন্যদেরকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে বলুন। তারপর রেলওয়ে হিলে আমার সদর দফতরে দেখা করবেন।”

 খাওয়া থেকে উঠেই আমি হালিশহরে ই-পি-আর সদর দফতরে ফোন করলাম। সেখানে বাঙ্গালী জেসিও'রা আমার নির্দেশের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তাঁদেরকে বললাম, “এক্ষুনি সব ফাঁড়িতে দ্বিতীয় সাংকেতিক বার্তাটি