পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৬৫

 এদিকে চট্টগ্রাম শহরের বিচ্ছিন্ন প্লাটুনগুলো খবর পেয়ে লড়াই কেন্দ্রগুলোর দিকে এগোচ্ছিলো। শুধু বিমানবন্দরের প্লাটুনটির সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না। এটা আমার জন্য খুবই বিপদের কারণ ছিলো। কেননা, পরিকল্পনা মোতাবেক শত্রুরা যাতে বিমান বন্দর ব্যাবহার না করতে পারে তার দায়িত্ব ছিলো এই প্লাটুনের ওপর। এখান দিয়ে সৈন্য আনা-নেয়া বন্ধ করতে পারলে বিমান বন্দর, পোর্ট এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতরসহ সমগ্র এলাকায় আমাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সহজতর হতো। বিমানবন্দরের টেলিফোন এক্সচেঞ্চ অপারেটরকে গোপনে চবিবশ ঘণ্টা লাইন চালু রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু ২৫শে মার্চ সন্ধ্যার পরই নৌ-বাহিনীর সদর দফতরের সৈন্যরা গোপনে বিমানবন্দরে গিয়ে পুরো প্লাটুনের লোকদের গ্রেফতার করে ফেলে। ফলে এখানে আমাদের বড় একটা ক্ষতি হয়ে যায়।

 উপকূলীয় বাধ বারবার শত্রু সৈন্যর চলাচল প্রতিরোধ করার জন্য দুটি প্লাটুনকে পাঠানো হলো। একটি কোম্পানী রেলওয়ে হিল প্রতিরক্ষার দায়িত্বে রইলো। প্রায় ১০০ সৈন্যকে দুই অথবা তিনজনের ছোট ছোট দলে ভাগ করে আগ্রাবাদ রোড এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন এলাকার মোড়ে মোড়ে লড়াইয়ের জন্য মোতায়েন কর হলো। বাকী সৈন্যদের হালিশহরেই সংরক্ষিত রাখ হলো- যাতে কোথাও বিপদ দেখা দিলে তারা সেদিকে যেতে পারে। রামগড়ের সৈন্যদের কাছে পাঠানো বার্তায় তাদেরকে ফেনী নদীর ওপর শুভপুর সেতু ধ্বংস করে সেখানে একটি কোম্পানীকে প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থায় অবস্থান গ্রাহণ করতে এবং অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে প্রধান সড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসতে বলা হয়েছিলো।

 হালিশহর ত্যাগের আগে বন্দীদের একটি ভবনে কঠোর প্রহরাধীনে রাখার এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে রাত ১১টা ৪৫মিনিটের মধ্যে আমি রেলওয়ে হিলের সদর দফতরে পৌঁছলাম। এখানে পৌঁছে নৌ-বাহিনীর সদর দফতর, পোর্ট এলাকা এবং বিমানবন্দরের ওপর আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে সীমান্ত এলাকার সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি ভেবেছিলাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টার এবং ষোলশহরে মোতায়েন ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বাঙ্গলী সৈন্যরা ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করতে সক্ষম হবে। রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের কমাণ্ডে ছিলেন লেঃ কর্নেল চৌধুরী এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। এ দুজায়গায় বাঙ্গালী সৈন্যদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ২০০০ এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো আনুমানিক ৪০০।

 রাত তখন ১১টা ৩০ মিনিট। হঠাৎ ২০ বালুচ রেজিমেণ্টের সৈন্যরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের বাঙ্গালী সৈন্যদের ওপর হামলা চালালো। অস্ত্রাগারের গার্ডদের হত্যা করে প্রথমে তারা সেগুলো দখল করে। অন্যান্য বাঙ্গালী সৈন্য তখনও ঘুমিয়ে ছিলো। অস্ত্রাগার দখলের পরই পাকিস্তানী সৈন্যরা নির্বিচার হত্যালীলায় মেতে ওঠে। সে রাতে তারা এক হাজারেরও বেশি বাঙ্গালী সৈন্যকে হত্যা করে। এরপর তারা বাঙ্গালী সৈন্যদের আবাসিক কোয়ার্টারগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং অস্ত্রের মুখে যাকে পায় তাকেই হত্যা করতে থাকে। নারী ও শিশুদের বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে মারা হয়।

 এই হত্যালীলা থেকে যেসব বাঙ্গালী সৈন্য জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলো তারা চারদিকে দৌড়াতে শুরু করে। কেউ কেউ আমার দফতরে এসে সেই লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দেয়। অন্যারা ষোলশহরস্থ ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দিকে ছুটে যায়। এই রেজিমেণ্টের অধিকাংশ অফিসার এবং সকল সৈন্য ছিলো বাঙ্গালী।

 কিছুসংখ্যক সৈনিক ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পালিয়ে ষোলশহরে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সঙ্গে রাত প্রায় একটার দিকে যোগাযোগ করে সেনানিবাসে আক্রান্ত বাঙ্গালী সৈনিক এবং তাদের পরিবারবর্গের প্রাণ রক্ষায় এগিয়ে যাবার জন্য তাদেরকে অনুরোধ জানায়। সেই ভয়াবহ রাতে বাঙ্গালী অফিসার ক্যাপ্টেন এনাম সেনানিবাস থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।