পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৬৮

।।সশস্ত্র প্রতিরোধ।।

 চট্টগ্রাম, ২৬শে মার্চ। আমার দফতরে টেলিফোনে খবর এলো যে পাকিস্তানী সেনারা নৌ-ঘাঁটি থেকে অগ্রসর হয়ে হালিশহরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের ওপর আক্রমন চালিয়েছে। ই-পি-আর ট্রাপস এই আক্রমণ প্রতিহত করে। শত্রদের প্রচুর হতাহত হয়। পাকিস্তানীরা হালিশহরে কোন বাধা আশা করেনি। সংগঠিত প্রতিরোধ মোকাবিলার জন্য তারা প্রস্বত্ততই ছিলো না। তাদের অগ্রবর্তী দলটি হালিশহরের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যুহের সম্মুখীন হতেই আমাদের সৈনিকরা পাকিস্তানীদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো। পাকিস্তানীরা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়ে। বহু সংখ্যক হতাহত হলো। অবশেষে তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। এ সময়ে অপর এক টেলিফোনে জানলাম, ৮০ থেকে ১০০টি যানের বিরাট একটি কনভয় কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছে। কুমিল্লা থেকে মেজর বাহার চট্টগ্রাম টেলিফোন অপারেটরকে একথা জানালে সে তৎক্ষণাৎ আমাকে তা অবহিত করে। সংবাদ পাওয়ার পরপরই আমি পাকিস্তানী কলামটিকে এ্যামবুশ করার জন্যে একজন জেসিওর নেতৃত্বে হালিশহর থেকে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠালাম। হালকা মেশিনগান এবং ভারী মেশিনগান ছাড়াও কোম্পানীটির সাথে ছিলো ৩” মর্টার ও রকেট লাঞ্চার। অপারেশনাল কমাণ্ডার সুবেদার মুসা যাত্রার প্রাক্কালে আমাকে টেলিফোন করে বললেন। আমাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করবেন স্যার।

 সকল দেশবাসী আপনাদের জন্য দোয়া করছে। যুদ্ধ চালিয়ে যান, মাতৃভূমিকে মুক্ত করুন। আমার গলার স্বর ছিলো আবেগে উদ্বেলিত।

 কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামগামী শত্রপক্ষে ছিলো ২৪ ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেণ্ট ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি অংশ এবং তাদের সঙ্গে ১২০ মিলিমিটার মর্টারবাহী একটি দল। ২৬শে মার্চ রাত ১টার দিকে তারা চট্টগ্রামের পথে কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট ত্যাগ করে। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দুরত্ব একশ মাইলের কিছু বেশি। তাদের পথে বহুসংখ্যাক কালভার্ট এবং ছোট ছোট সেতু ছিল। সৈন্য চলাচলে বাধাদানের জন্যে পূর্বেই জনসাধারন এগুলোর অধিকাংশ ভেঙ্গে ফেলেছিলো। তাই পাকিস্তানী কলামটিকে অনেক ক্ষেত্রে মুল রাস্তা ছেড়ে ঘুড়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। একই সাথে ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারের সৈনিকরা সেতুগুলো মেরামতও করে চলছিলো। যা হোক, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শুভপুরে সেতুর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে রাখা হয়েছিলো। কুমিল্লাস্থ ৫৩ ব্রিগেড কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি নিজেই সমগ্র কলামের নেতৃত্বে ছিলেন। শুভপুর সেতু রওনা হলেন এবং পিছনে রেখে গেলেন মর্টার এবং ইঞ্জিনিয়ার ইউনিটকে। তাদের বলে গেলেন সেতু মেরামত করতে তারা যেন অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে যোগ দেয়। সুর্য তখন অস্তপ্রায়। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি এবং তার বাহিনী চট্টগ্রাম থেকে ১৪ মাইল দূরে কুমিরায় পৌছে গেলেন।

 এদিকে ইপিআর সেনারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রাস্তার পূর্ব পাশের একটি উচু জায়গায় এ্যামবুশ করে বসেছিলো। রাস্তার পশ্চিমে কিছু দুরেই সাগর। উচু জায়গাটি থেকে রাস্তা এবং সাগর বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। বড় সেতুগুলোর কষ্টসাধ্য বাধা পেরিয়ে আসতে পেরে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি খুব খুশী ছিলেন কারণ সেতুগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হলে তাদের পক্ষে সেতু পার হওয়া সম্ভব হতো না। সমস্যার মুহুর্তে সেনাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন এবং তারপরই নামতে পারবেন বাঙ্গালীদের শায়েস্তা করতে। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি জীবনের সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। ইপিআর সেনাদের এ্যামবুশে তিনি এবং তার প্রায় অর্ধেক সৈন্য দিশেহারা হয়ে পড়লো।

 এই এ্যামবুশে পাক সেনাদের হতাহতের খবর পরে পাওয়া গিয়েছিলো। লাইট মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলির শিকার হয়েছিলেন ২৪ ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেণ্টের কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল শাহপুর খানসহ প্রায় ৭০