পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৭০

যে ক'জন সৈন্য ছিলো শুধু তাদের সম্বল করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর গত্যন্তর ছিলো না। নৌ- বাহিনীর সদর দফতর এবং পোর্ট মুক্ত করার পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো।

 বেলা ৯টা নাগাদ অনেক উঁচু দিয়ে শহরে হেলিকপ্টার ঘোরাঘুরি শুরু করলো। কয়েক জায়গায় জনসাধারণ সেগুলোর দিকে বন্দুকের গুলি ছুড়লো। বিরাটাকায় সি-১৩০ বিমানগুলো ঢাকা থেকে সৈন্য আনতে থাকলো। অসহায়ভাবে তবু আমরা সেই অবস্থান আকড়ে রইলাম। আমাদের প্রচেষ্টা ছিলো, ক্যাণ্টনমেণ্ট এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতর থেকে শত্রুদের বেরোতে না দেয়া। কিন্তু ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের অধিকাংশ সৈন্য নিহত হওয়ায় এবং ৮ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট শহর ত্যাগ করায় ওদিক দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের বেরোনো সহজতর হয়ে উঠেছিলো। ঘটলোও তাই। ট্যাংকের ছত্রছায়ায় ২০ বালুচ রেজিমেণ্টের সৈন্যরা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বেরিয়ে পড়লো।

 নৌ-বাহিনী সদর দফতরের পাকিস্তানী সৈন্যরা অবশ্য তখনো আটকা অবস্থায়। সমগ্র আগ্রাবাদ রোডের গুরুত্বপূর্ন স্থানগুলো ছিলো ইপিআর সৈন্যদের দখলে। হালিশহরের কাছে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম বলে শত্রুপক্ষের একটি লোকের পক্ষেও চলাচল করা সম্ভব ছিলো না। এমনিভাবে ওদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা আমরা অনেকখানি ব্যাহত করতে পেরেছিলাম।

 চট্টগ্রামে পাকিস্তানীদের সাহায্যার্থে বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য ২৬শে এবং ২৭শে মার্চ ঢাকা থেকে বিমানযোগে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে এসে পৌঁছায়। বিমানবন্দর থেকে পাকসেনারা আগ্রাবাদ এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাক শেনাদের অপর একটি গ্রুপ হালিশহর ইপিআর সদর দফতরের দিকে অগ্রসর হয়। হালিশহরে আমরা ইপিআর বাহিনী আগে থেকেই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলেছিলো।

 কুমিরার সংঘর্ষ মারাত্মক হয়ে পড়ে। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির সৈন্যদের মনোবল এতই ভেঙে পড়েছিলো। যে, তাদের পক্ষে আর সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিলো না। এই সময় হেলিকপ্টার যোগে জেনারেল মিঠঠা খান কুমিল্লায় উপস্থিত হন এবং সৈন্যদের প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে এক জঘণ্য মিথ্যা ভাষণে বলেনঃ “হিন্দুদের প্ররোচনায় বাঙ্গালীরা তোমাদের অফিসার, সৈন্য এবং তাদের পরিবার পরিজনকে হত্যা করে চলছে। তোমরা তাদের রক্ষা না করলে তারা সকলেই প্রাণ হারাবে। প্রতিশোধ গ্রহনের জন্য তোমরা সামনে এগিয়ে যাও। খুনের বদলে খুন। ইসলাম এবং পাকিস্তানকে তোমরা রক্ষা কর।” প্রতিশোধ গ্রহনের এই তীব্র হলাহল পাকিস্তানী সৈনিকদের মনে ব্যাপক জিঘাংসা সৃষ্টি করে।

 মূল সড়ক পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব না হওয়ায় ব্রিগেডিয়ার শফি পাহাড়ের ভিতর দিয়ে একটি কলামকে সেনানিবাসে ২০ বালুচ রেজিমেণ্টের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। অপর কলামকে উপকূল রেখা বরাবর অগ্রসর হয়ে বাধের উপর তরিত অবস্থান গ্রহনকারী আমাদের সৈন্যদের ঘিরে ফেলার নির্দেশ দেন।

 সন্ধা হয়ে আসে। মাঝে মাঝেই উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় চলছিলো। সংঘর্ষ এলাকা থেকে জনসাধারন ক্রমশঃ দুরে সরে যেতে থাকলেও এলাকার তরুনরা আমাদের সৈনিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে খাবার এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে থাকে। এমনকি তারা হতাহতদের নিরাপদ স্থানে সুচিকিৎসার ব্যাবস্থাও করতে থাকে। সৌভাগ্যের বিষয় ছিলো তাদের অনেকেই শত্রুসৈন্যদের কাছাকাছি থেকে তাদের প্রতিটি অবস্থানের খবরাখবর আমাদের সর্বরাহ করে চলছিল।

 উপকূল বরাবর শত্রুসৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়েই আমরা আরেকটি এ্যামবুশের আয়োজন করি। পাকিস্তানীরা আমাদের এ্যামবুশে পড়ে যায়। এই দ্বিতীয় এ্যামবুশেও শত্রুসেনাদের অনেকে হতাহত হয়। ভীত পাকিস্তানীরা তাদের মৃত সঙ্গীদের ফেলেই নানা দিকে দৌড়াতে থাকে। অনেকেই পথ ভুলে গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়লে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ জনতার হাতেই প্রাণ হারায়।