পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৭৬

 এ সময় তোফায়েল আহমদ কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেখ মনি বলেন, তোফায়েল আহমদের কলকাতা যাওয়া দরাকার। শেখ মনি কিছু নির্দেশসহ তোফায়েল আহমদকে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন।

 মনসুর ভাই-এর জ্বর এসে গেছে। তিনি শুয়ে আছেন। আমি তার পাশে বসে আছি। তার সাথে আমার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে তার সাথে আলাপ করলাম। তিনি মত দিলেন তাজউদ্দিন ভাই প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কোন আপত্তি করবেন না। এরপর মনসুর ভাই বা কামরুজ্জামান ভাই প্রধানমন্ত্রীর পদের ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন তোলেননি।

 পাঁচজন নেতার মধ্যে তিনজনের সাথে আলাপের পর আমার খুব বিশ্বাস হয়েছিল যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজউদ্দিন ভাই-এর প্রধানমন্ত্রীত্বে কোন আপত্তি করবেন না। তাছাড়া তাকে উপরাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। এখন বাকি রইলো খন্দকার মোশতাক আহমদ। শুধু তিনি আপত্তি করতে পারেন।

 তবুও চারজন এক থাকলে মোশতাক ভাইকেও রাজী করানো যাবে। এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন ভাই-এর প্রথম বক্তৃতা প্রচার করার পালা। তাজউদ্দিন ভাই প্রচারের জন্য চোখে অনুমতি দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড করা বক্তৃতার ক্যাসেট গোলক মজুমদারের কাছে দেয়া হলো।

 শেখ মনি তাজউদ্দিন ভাই-এর সাথে একান্তে আলাপ করতে চাইলেন। আমি বাইরের ঘরে বিএসএফ-এর আঞ্চলিক কর্মকর্তার সাথে দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা ও শত্রুদের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করলাম।

 শেখ মনির সাথে কথাবার্তা শেষে তাজউদ্দিন ভাই আমাকে ডাকেন। তিনি জানান, শেখ মনি এখন সরকার গঠনের ব্যাপারে রাজী নন। আগরতলা গিয়ে দলীয় এমপি, এমএনএ ও নেতা-কর্মীদের সাথে বৈঠক শেষে শেখ মনি সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন। আর এটা করা না হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

 আমি সরকার গঠনের পক্ষে পুনরায় যুক্তি দিলাম। আমি বললাম, সরকার গঠন করতে বিলম্ব হলে সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে এবং এতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া সরকার গঠনের পরিকল্পনা তো নতুন কিছু নয়। মনসুর ভাই ও কামরুজ্জামান ভাই তাজউদ্দিন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও খন্দকার মোশতাক আহমদের তখনো দেখা নেই। তাঁরা কে কোথায়, কি অবস্থায় আছেন, সে খবর এখনো আসেনি। ইতিমধ্যে বন্ধুরাষ্ট্রের সাথে আমাদের কিছুটা রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সরকার গঠনে বিলম্ব হলে নাও নস্যাৎ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার গঠন করার ব্যাপারে ভারত সরকারকে আমরা আশ্বাস দিয়েছি। তাতে বিলম্ব হলে আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কেও তারা সন্দেহ পোষণ করবেন। আমাদের মধ্যে যে কোন্দল রয়েছে কোন অবস্থাতেই তা বাইরে প্রকাশ হতে দেয়া উচিত নয়। ভারত সরকারও জানেন, আমাদের বক্তৃতা শিলিগুড়ির এই জঙ্গল থেকে আজ প্রচারিত হবে। আমার এসব কথা শেখ মনি মানতে রাজী নন। বেশি করে বুঝাতে চাইলে শেখ মনি জানান, তারা বঙ্গবন্ধু থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কারো প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। এ সময় তাজউদ্দিন ভাই আমাকে বলেন, আমি যেন গোলক মজুমদারকে জানিয়ে দেই যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা আজ প্রচার করা হবে না। এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তাকে যথাসময়ে জানানো হবে।

 গোলক মজুমদারকে ফোন করে জানাই যে আজ বক্তৃতা প্রচার করা হবে না। এ কথা শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিলম্ব করা কি ঠিক হবে? তিনি বলেন, যে মুহূর্তে সব কিছু ঠিক ঠাক সে মুহূর্তে তা স্থগিত রাখলে সব মহলে যে প্রশ্ন দেখা দেবে? তা আমরা ভেবে দেখছি কিনা। ইতিমধ্যে রেকর্ড করা ক্যাসেট নির্ধারিত স্থানে (জঙ্গলে) পৌঁছে গেছে।