পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৮০

 আমেরিকার ইণ্ডিপেনডেন্স বিল অনেকদিন আগে পড়েছিলাম। সেই অরিজিনাল দলিল চোখের সামনে ভাসছে। আর সেই বড় বড় হাতের স্বাক্ষরগুলো। কিন্তু ভাষা বা ফর্ম কিছুই মনে নেই। তবে বেশি কিছু মনে করার চেষ্টা করলাম না। শুধু মনে করলাম, কি কি প্রেক্ষিতে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার রয়েছে। এমনি চিন্তা করে ঘোষণাপত্রের একটা খসড়া তৈরি করলাম। স্বাধীনতা ঘোষণায় অস্থায়ী প্রেসিডেণ্টের ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয়া হলো।

 স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়া রচনার পর তাজউদ্দিন ভাইকে দেখালাম। তিনি পছন্দ করলেন। আমি বললাম, আমরা সকলে এখন যুদ্ধে অবতীর্ণ। এই দলিলের খসড়াটি কোন একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভাল হতো। তিনি বললেন এই মুহূর্তে কাকে আর পাবেন, যদি সম্ভব হয় কাউকে দেখিয়ে নিন।

 ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এদের মধ্যে সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। আমি তার লেখা কিছু নিবন্ধ পড়েছি বলে মনে হলো। বিএসএফ-এর মাধ্যমে রায় চৌধুরীর ঠিকানা জেনে নিলাম। টেলিফোনে তাকে যোগাযোগ করি। বললাম তাঁর সাথে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন। বালিগঞ্জে তার বাসা। আমার পরিচয়, ‘রহমত আলী’ নামে। সুব্রত রায় চৌধুরীর বাসায় পৌঁছে তাকে আমার প্রণীত ঘোষণাপত্রের খসড়াটি দেখালাম। খসড়াটি দেখে তিনি আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন। এই খসড়া আমি করেছি কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি হ্যাঁ সূচক জবাব দেই। তিনি বলেন, একটা কমা বা সেমিকোলন বদলাবার প্রয়োজন নেই।

 তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার যে আইনানুগ অধিকার, তা মানবাধিকারের একটা অংশ। এই কথা স্বাধীনতার সনদে ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, তিনি এর ওপর একটা বই লিখবেন। এই ঘোষণাপত্রের একটা কপি তাকে দেয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন। এরপর আইন ব্যবসা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশেল স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বই লেখা শুরু করেন। তার রচিত বইটির নাম হচ্ছে ‘জেনেসিস অব বাংলাদেশ’—আন্তর্জাতিকভাবে অধ্যয়নের জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার বহুবিধ বিদ্যালয়ে এখন তা পড়ানো হচ্ছে।

 এটা ছিল সুব্রত চৌধুরীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর থেকে যুদ্ধ সমাপ্ত পর্যন্ত তিনি আমাকে বড় ভাই-এর মত সময়ে অসময়ে সাহয্য সহযোগিতা করেছেন। আমার জন্য তাঁর দুয়ার সর্বদাই ছিল খোলা।

 এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানির সামরিক পোষাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোষাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোষাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোন পোষাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে, দর্জি ডেকে তাঁর জন্য পোষাক তৈরি করা হলো।

 শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর। ১৬ই এপ্রিল আমরা দু’জনে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দু’জন প্রতিনিধি বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সার্চ লাইটের মত অসংখ্য চোখ আমাদের দিকে নিবদ্ধ। ক্লাবের সেক্রেটারী উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদেরকে প্রথম অনুরোধ জানাই আমাদের উপস্থিতির কথা গোপন রাখতে হবে। এরপর বললাম, আমরা বাংলাদেশ সরাকারের পক্ষ থেকে একটি বার্তা নিয়ে এসেছি।

 সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ই এপ্রিল কাক ডাকা ভোরে এই প্রেসক্লাবে হাজির হতে অনুরোধ জানাই। বললাম, তখন তাদেরকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেয়া হবে। তাদের কেউ কেউ আরো প্রশ্ন করতে চাইলেন। আমরা কোন উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করি। এতে