পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৮৬

বেড়ে চলেছে। ২৫শে মার্চের পর ঢাকা থেকে যে হারে মানুষ গ্রামে চলে গিয়েছিল আজো সেই হারে বাংলাদেশ থেকে মানুষ সীমান্ত পার হয়ে আসছে।

 কলকাতা ফিরে আইনজীবী সুব্রত রায় চৌধুরীর সাথে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচানা করি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতির কর্মকর্তাদের সাথে আমার যোগাযোগ করে দেন। সমিতির সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তিনি বলেন, তিনি সীমান্তের দিকে যাবেন। কৃষ্ণনগর ও নদীয়া জেলা সীমান্তে। আমি গেলে তিনি নিয়ে যেতে পারেন। আমি রাজী হলাম। কথা হলো, তিনি আমাকে বাংলাদেশ মিশন থেকে তুলে নেবেন।

 সীমান্তে যাওয়ার জন্য আমি হাতের কাজ গুছিয়ে নেই। আমার সেখানে যাওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। কারণ, সীমান্তের এই অঞ্চলে নিজের জেলা কুষ্টিয়ার অনেকের সাথে সাক্ষাৎ হবে। কৃষ্ণনগরে গিয়ে দেখি, স্থানীয় সমাজকর্মীরা এক বাড়ীতে অফিস করেছে। সেদিন সেখানে শরণার্থী সমস্যার সমাধান ও মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে সর্বদলীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। প্রফেসর দিলীপ চক্রবর্তী বৈঠকে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। আমাকে পেয়ে তারা খুশী হন।

 আমি সামাবেশে আমাদের সংগ্রাম, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নিয়ে আলোচনা করি। বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিম বংগের সচেতন অধিবাসীদের কাছ থেকে কি আশা করি তাও জানালাম। ছোটবেলায় দাদুর মুখে শোনা কৃষ্ণনগর, ‘পুতুল খেলাম কৃষ্ণনগর’ আজ স্বচক্ষে দেখলাম। বাংলাদেশের ভিটে মাটি হারা মানুষ আসছে। কিন্তু এপারের জনগণ আঁৎকে ওঠেনি। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় বলেই এপারের মানুষ ওপারের ভাগ্যাহত মানুষদের আশ্রয় দিচ্ছে। বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসলে চুয়াডাঙ্গার সকল কর্মী ভাইয়েরা আমার সাথে কোলাকুলি করেন। এদের মধ্যে মিছকিন মিয়া, ফকীল মোহাম্মদ, ডাঃ নজির আহমদসহ আরো অনেকে ছিলেন। তাদের মুখে অনেক কথা শুনলাম। আমি তাদেরকে বললাম, এদেশে আমরা যেন বাস্তুহারা হয়ে না যাই। এই যুদ্ধে সকলকে অংশ নিতে হবে। যিনি অস্ত্র হাতে নিতে পারবেন, তিনি প্রশিক্ষণ নেবেন। আর যিনি তা পারবেন না, তাকে সহকারী হিসেবে যুদ্ধের সামগ্রী বহন করতে হবে। সকলকে একত্র থাকতে হবে। যা পাই তা ভাগ করে খেতে হবে। আমি তখন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব ছাড়াও জেলার প্রতি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।

 এর পর আমি কয়েকদিন ধরে কুষ্টিয়া জেলার দলীয় কর্মীদের খুঁজে বের করি। চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রচার সম্পাদক (বর্তমানে জাসদ-নেতা) মীর্জা সুলতান রাজা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কুষ্টিয়া আওয়ামী লীগ সংগঠনের সাংগঠনিক ব্যাপারে তিনি আমাকে সক্রিয় সহায়তা করেছেন। সামাজতন্ত্রিক ও বিপ্লবী কর্মী গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। তাঁকে খুঁজে বের করি। মীর্জা সুলতান, আবুল হশেম, ডাঃ নাজিরসহ আরো অনেকে মিলে একটি বাড়ীতে একটি ক্যাম্প গড়ে তুলেছে। বিভিন্নভাবে তাঁবু, খাবার ও রান্নার জিনিসপত্র যোগাড় করা হল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতি বিশেষ করে দিলীপ চক্রবর্তী এ ব্যাপারে বিশেষ সহযোগিতা করেন।

 এমনিভাবে বয়রা, মামাভাগ্নে, কৃষ্ণনগর, শিকারপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের দলীয় কর্মীদের উদ্যোগে ছোট ছোট ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এগুলোর মধ্যে শিকারপুরের অবস্থা অতি করুণ। কুষ্টিয়া সদর কুমারখালী, রাজাবড়ী ইত্যাদি অঞ্চলের লোকজন এখানে জমা হয়েছে। একটি ছোট গুদাম ঘর স্থানীয় লোকেরা ছেড়ে দিয়েছে। সেখানে সকল রজনৈতিক কর্মী স্থান নিয়েছেন। কুষ্টিয়ার আব্দুল হামিদ, আজিজ মিয়া, আবুল কালাম, জলিল সবাই এখানে স্থান নিয়েছেন। এক হাঁটু পানি দিয়ে এই গুদাম ঘরে যেতে হয়। কোন রকমে ছাউনি দিয়ে রান্নার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। মাটিতে বিছানা পেতে থাকতে দেয়া হচ্ছে। এক কষ্টের মধ্যে থেকেও এদের মনোবল ও উদ্দীপনা কমেনি। কিভাবে দেশ স্বাধীন হবে, এই যেন তাদের সবসময়ের চিন্তা। মেহেরপুরের এমপিএ মহিউদ্দিন, এমপিএ নূরুল হক, জলিল এঁদেরকেও খুঁজে পেলাম। তারা একটি পাটের গুদামে আশ্রয় নিয়েছে।