পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৯২

 মে-জুন মাসের দিকে আগরতলা গিয়েছিলাম। সেখানে আমার স্ত্রীর বড় ভাই আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম শামছুজ্জোহা তার পরিবার পরিজন নিয়ে আসেন। তাঁদের কাছে আমার পরিবারের খোঁজ খবর পাই। আমার পরিবার যখন কলকাতায় পৌঁছেন, আমি তখন উপস্থিত থাকতে পারিনি। বিএসএফ-এর মিঃ চট্টপাধ্যায় একটি কারগো বিমানে করে তাদেরকে আগরতলা থেকে কলকাতা নিয়ে যান। বিএসএফ-এর ভাড়া করা বাড়ী কোহিনূর ম্যানসনে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এসময় আমি খুব ব্যস্ত। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি প্রচণ্ড সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছিল।

 প্রথম থেকে মন্ত্রিসভার প্রতি আমাদের যুব সমাজের একটা অংশের বিরূপ মনোভাব ছিল। তারা মুজিব নগর সরকারের নেতৃত্ব মেনে নিতে অনীহা প্রকাশ করছিলেন। যুকবদের এই অংশের কাজ ছিল বিভিন্নভাবে সরকারকে অপদস্ত ও হয়রানি করা। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পর্যন্ত মুজিব নগর সরকারের নেতৃত্ব সম্পর্কে কুৎসা ও ভূল তথ্য পরিবেশন করে। অপপ্রচারের অংশ হিসেবে তারা প্রচার করে যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ প্রতি অধিকাংশের সমর্থন নেই।

 এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য ও নেতাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। কারণ এমন একটি বৈঠকই প্রমাণ করতে পারে যে তাজউদ্দিন সরকারের প্রতি সংশ্লিষ্ট সকলের শুধূ সমর্থনই নেই, এ পর্যন্ত তাঁর সকল কার্যক্রমের প্রতিও তাদের অনুমোদন রয়েছে।

 এই উদ্দেশ্যে শিলিগুড়ির জঙ্গলে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। নদীর পাশে পাহাড়িয়া এলাকার এই জঙ্গলে বৈঠকের জন্য অনেকগুলো তাঁবু টানানো হয়। নির্বাচিত সদস্য ও দলীয় নেতাদেরকে বৈঠকে একত্রিত করার ব্যাপারে বিএসএফ-এর চট্টপাধ্যায়ের বিরাট অবদান রয়েছে।

 বৈঠকে খোলাখুলিভাবে সরকারের কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আস্থা ও সমর্থন প্রকাশ করা হয়। এতদিন যারা তাজউদ্দিন সরকারের অপপ্রচার করেছিল, বৈঠকের ফলে তাদের মুখে ছাই কালি পড়ে। শিলিগুড়ির বৈঠকের পর কলকাতা বিমান বন্দরে এসে জানলাম, আমার পরিবারবর্গ এসেছে।

 কোহিনূর ম্যানসনের ফ্ল্যাটে স্ত্রী, মেয়ে ও পুত্রের সাথে মিলিত হলাম দীর্ঘ দিন পর। ফ্ল্যাটে কোন আসবাবপত্র নেই। মেঝেতে বিছানা পাতা রয়েছে। একই ফ্ল্যাটে আমরা ছাড়াও শামসুজ্জোহা ও মুস্তাফা সরওয়ারের পরিবারবর্গ রয়েছে। জায়গার তুলনায় আমরা লোক ছিলাম বেশী।

 এ সময় হানাদার বাহিনীর সমর্থকরা আমার গ্রামের বাড়ী জ্বালিয়ে দিলে তারা গৃহহারা হন। অসুবিধা হলে দেশ ছাড়ার জন্যে আমি আববাকে ইতিপূর্বে খবর দিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, দেশের মাটিতে থেকেই আমাদের জন্যে তিনি দোয়া করছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় চাকরি সূত্রে তিনি কলকাতায় কাটিয়েছেন। তার কালকাতা আসার কোন ইচ্ছা ছিল না। বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পরে আত্মীয়স্বজনরা এক প্রকার জোর করে আববাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন।

 হানাদাররা আমার বাড়ীর সকল সম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায়। তাদের গুলিতে আমার চাচী আহত হন। বাড়ীর মেয়েরা অন্যত্র আত্মীয়দের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। আববাসহ যুবক ও অন্যান্য পুরুষ মানুষ কলকাতা চলে আসেন। ২৫শে মার্চের রাত থেকেই এ পর্যন্ত তাজউদ্দিন ভাই ও আমি একত্রে থেকেছি। পরিবার আসার পর তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম। তাকে ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাছাড়া রাতের বেলায় এই বিচ্ছিন্নতায় কাজেরও বিরাট ক্ষতি হলো। কেননা, এতদিন দিনের শেষে রাতের বেলা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতাম। আমার স্ত্রী অন্তঃসত্তা। তাছাড়া সকল প্রতিকূলতার ভেতর সংগ্রাম করে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে জীবন যাপন করে খুবই দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। স্ত্রীর এই শারীরিক অসুস্থতার সময়