পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৯৩

আমার কাছে থাকা খুবই প্রয়োজন। অসুস্থ স্ত্রীকে ডাঃ অমীয় ঘোষের কাছে নিয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে গেছে। প্রথম থেকেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কাজ করে আসছেন। আমার স্ত্রীর অবস্থা দেখে ডাক্তার চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারণ অপুষ্টি ও অনিয়মের কারণে গর্ভজাত সন্তান বিপদমুক্তভাবে প্রসব নাও হতে পারে। অন্যান্য সংসদ সদস্যদের হারে মাসিক যে টাকা পেতাম, তা দিয়ে কোন রকমে বাজার খরচ চলতো।

 আমার জন্য একটি সরকারী জীপ বরাদ্দ ছিল। এর জন্য প্রয়োজনীয় পেট্রোল দিতেন বলাইদা। বলাইদা ছিলেন একজন নামকরা সলিসিটর। তার এক মক্কেলের এক্সপেন্স এ্যাকাউণ্টে একটি নির্দিষ্ট পেট্রোল পাম্প থেকে স্লীপ দিয়ে গাড়ীর জন্যে পেট্রোল নিতাম। ৯ মাস যুদ্ধের সময় এই দানের পেট্রোল ছিল চলাফেরার একমাত্র সহায়।

 ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ভলাণ্টিয়ার সার্ভিস (বি ভি এস) গঠন করা হয়েছে। এই সংস্থা গঠনের উদ্দেশ্য, কার্যকরী কমিটি, উপদেষ্টা ঠিক করা হয়েছে। আমি নিজে বিভিএস-এর চেয়ারম্যান। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক করিমুদ্দিন আহমদ উপদেষ্টা এবং শাহীন স্কুলের অধ্যক্ষ মামুনুর রশীদ নির্বাহী পরিচালক।

 ‘ওয়ার অন ওয়াণ্ট’ আমাদের প্রাথামিক কাজের জন্য টাকা দেয়। প্রত্যেক শরণার্থী শিবিরে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। ‘ওয়ার অন ওয়াণ্ট’ বিভিএস কে একটি জীপও দেয়। সদর স্ট্রীটে গাজা সংলগ্ন বাড়ীতে মিশনের বদান্যতায় বিভিএস-এর অফিসের জন্য দুইটা ঘর পাওয়া গেল।

 কৃষ্ণনগরে সেচ্ছাসেবকদের একটি সম্মেলন হয় জুলাই-এর কোন এক সময়ে। শরণার্থী শিবিরে করণীয় কার্যক্রমের বিশদ বিবরণসহ পুস্তিকা ছাপানো হয়। সকাল বেলা সম্মেলনে যাত্রার পূর্বে দেখলাম, আমার স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতর। বেগম শামসুজ্জোহার সাহায্যে পাশের ক্লিনিকে তাকে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই অবস্থায়ও আমার স্ত্রী অত্যন্ত সাহসের সাথে আমাকে সম্মেলনে যেতে বলেন।

 এমনি এক অবস্থায় আমাকে সাহস দিয়ে সম্মেলনে প্রেরণের কথা কোনদিন ভূলে যাওয়া সম্ভব নয়। সম্মেলনে ডঃ মোশাররফ হোসেন, শিল্পী কামরুল হাসান, মামুনুর রশীদ প্রমুখ আমার সাথী হলেন। আমার বন্ধু ও রাজনৈতিক সাথী কুষ্টিয়ার কুমারখালি কলেজের অধ্যক্ষ দেওয়ান আহমদকে কৃষ্ণনগরে এই সম্মেলনের প্রস্তুতির ভার দিয়েছিলেন।

 বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে স্বেচ্ছাসেবক আসেন। এদের সকলেই রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী। তবে তাদের যুদ্ধে যাওয়ার বয়স নেই। আর্তমানবতার সেবা করাই সম্মেলনে আগত সকলের উদ্দেশ্য। ডঃ মোশাররফ হোসেন সম্মেলনে বক্তৃতা ছাড়াও কিছু ছাপানো পুস্তিকা বিতরণ করা হয়। এসব পুস্তিকায় বিভিএস-এর কর্মসূচী, শরণার্থী শিবিরে করণীয় কর্তব্য, স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় এবং স্বাধীনতার পর দেশ গঠনে এদের ভুমিকা লিপিবদ্ধ ছিল। সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে ডঃ স্বদেশ বোস এবং শিল্পী কামরুল হাসানও বক্তব্য রাখেন।

 কৃষ্ণনগর থেকে ফেরার পথে জানলাম, কুষ্টিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের কর্মীরা এখানে আশেপাশে রয়েছে। খবর পেলাম, কুষ্টিয়ার খোকসা থানার ৭টি গ্রাম পাক বাহিনী জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে। একতারপুর গ্রামের কাপালিকরাও গ্রাম ছেড়ে এখানে এসেছেন। এসব গ্রামের আবাল বৃদ্ধ-বনিতা আমাকে তাদের অত্যন্ত আপনজন জানতেন। কলকাতায় ফিরে প্রথমেই ক্লিনিকে যাই। বুকের ভেতর ছিল চাপা উত্তেজনা। ক্লিনিকে গিয়ে জানলাম আমার পুত্র সন্তান হয়েছে। মা ও সন্তান সুস্থ আছে বলেও জানলাম। আমরা সখ করে সন্তানের নাম রাখি জয়; কিন্তু আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। জন্মের পর জয় আমশায় রোগে আক্রান্ত হয় এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই