পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৯৯

কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে। সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের মাটিতে এই বীরদের কবর দেয়া হয়েছে। বালাটেও স্থানীয় নেতাদের সাথে আমাদের কয়েকদফা বৈঠক হয়।

 আমাদের ফেরত যাত্রা শুরু হল। শিলং-এ পৌছে দিনের কর্ম ব্যস্ততা শেষ করে পশ্চিম বাংলার একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকের বাসাই যাই। তার কাছ থেকে স্থানীয় রাজনীতি, আসাম ও মেঘালয় সরকারের মনোভাব সম্পর্কে অবহিত হই। এর পূর্বে আমি কয়েকবার গৌহাটি, আগরতলা ঘুরে গেছি। আসাম সরকার মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে খুব বেশী উৎসাহী ছিলেন না। শরণার্থী শিবিরগুলোতে খুবই কড়াকড়ি। তাই তাদের জীবন এখানে খুব সুখকর ছিল না।

 এর আগে ডোনাল্ড চেসওয়ার্থকে নিয়ে আমি আগরতলা গেছি। তাকে নিয়ে আমি সাবরুমে গেছি, এখানে ওপারে বাংলাদেশ সীমান্তে একটি রেষ্ট হাউজ রয়েছে। সেখানে হানাদার বাহিনী ক্যাম্প তৈরী করেছে। পাক হানাদার বাহিনী এখানে নারী নির্যাতন করছে। দস্যুরা নারীদের উলঙ্গ করে পর্যন্ত রাখে। ওপারের লোকের মুখে এসব নির্যাতনের কথা আমরা শুনি। সাবরূমের ডাকবাংলোতে বিশ্রামের সময় ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী মাহফুজুল বারীর সাথে আমাদের দেখা হয়। বারী একজন সাধারণ শরণার্থীর মত ডোনাল্ডএর কাছে বাংলাদেশে পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেন। ডোনাল্ড এসব কথা বৃটিশ সংসদে বলবেন বলে আমাদের জানান। এবং তিনি পরে তা করেছিলেন।

 হ্যানসার্ড-এর রিপোর্টে বাংলাদেশের এই করুণ আলেখ্য প্রকাশিত হয়। আমি জন স্টোন হাউজ, ডগলাস ম্যান, পিটার বার্নস এমপিসহ অনেক সাংবাদিককে নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে পৌছি। এমন একটি দল নিয়ে পাটগ্রামের মুক্তাঞ্চলে যাই। যুদ্ধ চলার সময়েও আমি বহুবার পাটগ্রাম গেছি। পাটগ্রামে একবার আমরা একটি ডাকঘর উদ্বোধন করি। এ সময় প্রখ্যাত ডিজাইনার বিমান বোস অংকিত স্বাধীনতা যুদ্ধের কোমেমোরেটিভ স্ট্যাম্প লণ্ডন ও কলকাতায় বিক্রি করা হয়।

 পাটগ্রামে ডাকঘর উদ্বোধন করার সময় টেলিভিশনসহ বিদেশী সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং মুস্তফা সারওয়ার অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। পাটগ্রাম থেকে আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যাই। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আমরা ১ রাত ১ দিন কাটাই। সামরিক ছাউনীতে আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়।

 আমরা দিনাজপুরের পঁচাগড় পর্যন্ত মুক্তাঞ্চলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ খবর নিই। আমাদের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কামান বিপুল উৎসাহে গর্জে ওঠে। আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে তখন কামান এসে গেছে। এই কামানের গোলায় দূরের পাকিস্তানী বাংকারগুলো ভেঙে পড়ছে। দুরবীন দিয়ে পলায়নপর পাক বাহিনী দেখে উল্লসিত হই।

 দিনাজপুর জেলার এই অঞ্চলের একটি গ্রামের সমস্ত অধিবাসী মুক্তিবাহিনীর জন্যে গ্রামটি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। গ্রামটির নাম মনে নেই। গ্রামের বেশীরভাগ বাড়ী-ঘরে টিনের বা খড়ের চালা। ঘরের ভিটিগুলো বেশ উঁচু। ঘরের ভিতরে বাংকার তৈরী করা হয়েছে। মেঝেতে গর্ত করে মাটির ভেতরে কামান বসানো হয়েছে। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর সেই উদাত্ত আহবান ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’ এ কথা মনে হতো। গোরস্থানে কবরের ভেতরেও অনেক স্থানে বাংকার হয়েছে। গ্রামবাসীরা মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ করছে। ছোট ছোট রাখাল ছেলেরা দূরে গরু চরাতে গিয়ে পত্র বাহকের কাজ করছে ও দূরে শত্রুদের অবস্থান জানাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ভিয়েতনামের জনগন পরম পরাক্রমশালী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বীরের মত লড়াই করেছে। প্রতিদিন বাংলাদেশের মাটিতে একাধিক বীরত্ব গাঁথা জন্ম নিচ্ছে। এই বীরত্ব গাঁথার সবগুলো হয়তো কোন দিনই লেখকের কলামে, কবির কবিতায় বা শিল্পীর কণ্ঠে শোনা যাবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হয়তো কোন দিনই লেখা হবে না। তবে ৯ মাস ব্যাপী