পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১০৩

পোষাক পরে ছাউনীর সবুজ ঘাসে শুয়ে আছে শহীদ ভাই। বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো শহীদের শরীর। তাকে সামরিক কায়দায় দাফন করে ক্যাম্পে ফিরে আসি। এসে দেখি, শহীদের স্ত্রী। কোলে অবুঝ পুত্র। সাথে ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। জানিনা, আজ তারা কে কোথায় কেমন আছে। যুদ্ধকালে এই পরিবারের ভরণ পোষণের ভার নিয়েছিল বাংলাদেশ ভলাণ্টিয়ার সার্ভিস। এমনি শত শত মুক্তিযোদ্ধা শুয়ে আছে সিলেটের বালাট সীমান্তে। তাদের শেষ ইচ্ছানুযায়ী বাংলার মাটিতে তাদের কবর দেয়া হয়। শুধু বালাট নয়, ২৪ পরগনার টাকি পর্যন্ত পুরো সীমান্তে শহীদের অসংখ্য কবর রয়েছে।

 পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করার সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেও আমি সেখানে একটা সংযোগ রাখার চেষ্টা করতাম। সেখানে আমার তদারকি মোশতাক আহমদ কিছুতেই পছন্দ করতেন না। খন্দকার মোশতাক মাহবুব আলম চাষীকে পররাষ্ট্র সচিব করেছেন। হোসেন আলী কলকাতা মিশনের প্রধান হিসেবে কাজ চালাচ্ছেন। হোসেন আলী থেকে শুরু করে কলকাতা মিশন ও পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা যেভাবে আমাকে সহযোগিতা দিয়েছেন, তা ভুলবার নয়।

 পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি প্রচার সেল খোলা হয়। আমার বন্ধু ও সহকারী মওদুদ আহমদ এ সেলে কাজ করতেন। এ সময়ে তার একটি পুস্তক বিদেশ অফিসের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। মান্নান সাহেব জয় বাংলা পত্রিকা ও বেতার পরিচালানার দায়িত্ব পালন করেন। ডাঃ টি হোসেন থাকেন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগের দায়িত্বে। তিনি যুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন শিবিরে আহতদের শুশ্রুষা চালু করেন।

 পররাষ্ট্র দপ্তরের ‘প্রকাশনা সেল’ কে একটি নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়। বিদেশী প্রতিনিধিদল আসলে তাদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব এরা পালন করতে থাকে। মিঃ বটমলির নেতৃত্বে একটি বৃটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে। এদের কলকাতা আসার কথা ছিল। তাদের সাথে কথাবার্তা বলার জন্যে আমরা একটি ছোট দল গঠন করি। এই দলে সৈয়দ আবদুস সুলতান, ডাঃ টি হোসেন, ডাঃ স্বদেশ বোস সহ আরো অনেকে ছিলেন।

 বেনাপোলের ডাকবাংলোতে বৃটিশ প্রতিনিধিদলের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের লোকদের বিভিন্ন শিবিরে পোষ্টার ও ফেষ্টুনসহ পাঠাই। প্রতিনিধিদল আসেন বেশ বিলম্বে। বটমলি বলেন, তারা সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলবেন। আমাদের ন্যায় বুদ্ধিমান মানুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমি বললাম যে, আমরা বুদ্ধি বিবেকহীন মানুষের অত্যাচারে আজ দেশ ছাড়া, গৃহহারা। বুদ্ধি বিবেক সম্পন্ন মানুষের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষায় আছি। তাই তাঁর এই পার্লামেণ্টারী ডেলিগেশনের সাথে আমাদের আলোচনা বিশেষ প্রয়োজন। আমাদের সমস্যা নিয়ে তাদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয়। তারা আমাদের পক্ষে সম্ভাব্য সব কিছু করার আশ্বাস দেন।

 টেড কেনেডী আসেন একবার। তাঁর সাথে আমাদের প্রতিনিধিদলের দেখা হয়। আমি ছাড়াও প্রতিনিধি দলে ছিলেন ডঃ স্বদেশ বোস ও মুস্তফা সারওয়ার। কেনেডী প্রথমেই জানতে চান, আমাদের জন্যে তারা কি করতে পারেন। আমি বল্লাম, মার্কিন জনগণ, সে দেশের পত্র-পত্রিকা ও কেনেডী আমাদের জন্যে যা করেছেন, এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমি আরো বলি, যুক্তরাষ্ট্র সরকার যদি কিছুই না করেন, তাহলেই আমরা খুশি। সফরের পর কেনেডীর রিপোর্ট আমাদের পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল।

 স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস চরমভাবে দেখা দেয়। এই উচ্চাভিলাস যুবক, ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে বন্দুকধারী মুক্তিযোদ্ধা, সিপাই, চাকরিজীবী সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। রাজনীতিকদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল তবে উচ্চাভিলাষীদের সংখ্যা তত বেশী ছিল না।

 মিলিটারীদের প্রতি যুবকদের একটা চরম অবিশ্বাস ছিল। তাদের অভিযোগ, এককালে এরা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে থাকায় তাদের ভাবধারা প্রভাবান্বিত। তাই তাদেরকে ক্ষমতায় আসতে দিলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আত্মবিকাশের চরম বিপর্যয় ঘটাবে।