পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১০৫

 কেবিনেটে তাজউদ্দিন ভাই-এর বিরুদ্ধে প্রথম থেকে চরম অসন্তোষের বারুদ নিয়ে বসেছিলেন খন্দকার মোশতাক। ব্যক্তিগত আক্রোশ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি ভিন্ন মনোভাব, যে কোন কারণেই হোক না কেন, মোশতাক অনেক কাজেই বাধা সৃষ্টি করেছেন।

 মোশতাক কখনো শেখ মনিসহ যুব নেতাদের উস্কিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। মোশতাকের ভাবশিষ্য তাহের ঠাকুর একবার স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের দিয়ে ধর্মঘট করার ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করেন। অবশ্য এসব সফল হয়নি। সাধারণ কর্মীদের সংগ্রামের প্রতি ছিল সমর্থন আর প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ছিল তাদের গভীর শ্রদ্ধা।

 অপরদিকে আওয়ামী লীগের দলগত দিক থেকে তাজউদ্দিন ভাই-এর মিজান চৌধুরীর একটি ক্ষোভ ছিল। প্রধানমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাজউদ্দিন ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ ছাড়েন নি।

 আর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভাসানী ন্যাপ, মোজাফফর ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি ইত্যাদি দলগুলোর দাবী ছিল একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করার। আওয়ামী লীগের বক্তব্য ছিল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সরকার গঠন যুক্তিযুক্ত হবে না। সর্বদলীয় সরকার গঠনের দাবীদারদের কেউ কেউ ভারতবর্ষের বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে লবি সৃষ্টি করতেও কুণ্ঠা বোধ করেননি।

 ভারতে সিপিআই ও সিপিআই (এম)- এর কংগ্রেসের ওপর প্রভাব থাকা খুবই স্বাভাবিক। তাদের কাছ থেকেও সর্বদলীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে আনাগোনা শোনা যেতে লাগলো।

 এ সবের অবসান ঘটাবার জন্যে প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের সাথে পরামর্শ করে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। এতে ভাসানী, মনি সিং ও মোজাফফর আহমদ সদস্য হলেন। উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়।

 উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সেরনিয়াবত এই প্রস্তাবের নেতৃত্ব দেন। শেখ আজিজ, শাহ মোয়াজ্জেমসহ আরো কেউ কেউ নেপথ্য থেকে এই প্রস্তাব চাঙ্গা করেন। অবশ্য আলোচনার পর এই প্রস্তাব নাকচ করা যায়।

 যুদ্ধকালে তাজউদ্দিন ভাইকে ঘায়েল করার জন্যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহল কম চেষ্ঠা করেনি। এই সব প্রচেষ্ঠা অনেক সময় সামগ্রিক সংগ্রামকে ব্যাহত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যখন কিছুই বলা সম্ভব হতো না, তখন তাকে উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলেছে। সে সময় কেউ কেউ এমন কথাও বলেন যে তাজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে ধরিয়ে দিয়ে ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামকে নিয়ে ভারতে এসে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী বলে ঘোষনা করেছেন।

 তাজউদ্দিন ভাই বহুদিনের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তিনি বঙ্গবন্ধুকেই তার জীবনের একমাত্র নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এসব ভাবতে হচ্ছে বলে তিনি অস্বস্তি বোধ করতেন। সহকর্মীদের মাঝে কাউকে খুঁজতেন তার এই ভার বইতে। মন ও মানসিকতার দিক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতির এই সংকীর্ণ মনোবৃত্তিতে কখনোই অভ্যস্ত ছিলেন না। তাই তাকে অনেক কষ্ট ও বেগ পেতে হয়েছে। কর্তব্যে অটল, নীতিতে দৃঢ়, কঠিন প্রত্যয় নিয়ে তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার চারিত্রিক গুণাবলীতে তার সংস্পর্শের লোকেরা মুগ্ধ হয়েছেন। ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্ব, মিসেস গান্ধী, সরকারী কর্মচারী, সাময়িক কর্মচারী বি এস এফ থেকে বিভিন্ন এজেন্সী সবাই মুগ্ধ ছিলেন। এদের সকলের সম্মান অর্জন করতে তিনি সক্ষম হন। গান্ধী ভাবধারায় প্রভাবিত ভারতীয় নেতৃত্ব তাজউদ্দিন ভাই -এর মত চরিত্রের লোকের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস স্থাপন করেন। দলের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আমাদের সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের বিপুল অংশ তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা