পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১০৮

করতেন মিঃ নাথ। পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালে হৃদরোগে তিনি মারা যান। মিঃ নাথ ছিলেন বাঙ্গালী সুপুরুষ ধীর স্থির ব্যক্তিত্ব। সচরাচর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীদের থেকে তিনি পৃথক ছিলেন। এছাড়া ছিলেন বি এস এফ- এর কর্মকর্তা। ইষ্টার্ণ সেক্টরের কমাণ্ডার গোলক মজুমদার প্রথম থেকেই সর্ব পর্যায়ে আমাদের দেখাশুনা করতেন। ভারতের সামরিক প্রতিনিধি জেনারেল সরকার আমাদের কম্যাণ্ডের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এ ছাড়া ও ছিলেন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। দিল্লী থেকে লিয়াজোঁ রক্ষা করার জন্যে কেউ কেউ কলকাতায় থাকতেন।

 পশ্চিম বঙ্গ কংগ্রেসের নেতা সাত্তার সাহেব আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। দিল্লী থেকেও অনেকে আসতেন। প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগ রক্ষা করার জন্যে আমাকে ন্যস্ত করেন। কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগ কখনই সফল রূপ নিতে পারেনি। তবে স্থানীয় সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এটা খুবই কার্যকরী হয়। কিন্তু নীতিগতভাবে এই লিয়াজোঁর খুব একটা প্রয়োজন ছিল না। এমনি বিভিন্ন মহল ও এজেন্সীর সাথে সমন্বয় করতে একটি মূল সূত্রের অভাব সর্বদা লক্ষ্য করেছি। ফলে অনেক সময় যোগাযোগের অভাব বিশৃংখলা ও বিভ্রান্তিতে পরিণত হয়। মিঃ ডি পি ধরের দিল্লীতে আসার সময় পর্যন্ত এই বিভ্রান্ত বিরাজ করছিল। ডি পি ধর ছিলেন একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। এই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি অতি অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপক প্রেক্ষিত সম্পর্কে একটি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী অর্জন করেন। মিঃ ধর যদি মিসেস গান্ধীর পক্ষে থেকে কাজ করতেন, তা হলে হয়তো বহু ভুল বুঝাবুঝি ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতো। দিল্লী সরকারের বিভিন্ন এজেন্সী, তাদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তাদের মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতার মনোভাব। ফলে সামগ্রিক উদ্দেশ্যে অনেকবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ডি পি ধরের সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয় আলোচনা করেন। মুজিব বাহিনী গঠনের ব্যাপারেও ডি পি ধরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।

 শামসুল হককে দিল্লীতে আমাদের পক্ষে কাজ করতে বলা হয়। শাহাবুদ্দিন প্রথম থেকেই পাক দূতাবাসের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে আমাদের সাথে চলে আসেন। একই সাথে দূতাবাসের প্রেস এটাচীও আসেন। এদের সাথে প্রথম থেকেই আমাদের যোগাযোগ হয়। প্রথমবার দিল্লী গিয়েই তাদের সাক্ষাৎ পাই। সেখানে অফিস করার ব্যাপারে তাদের সাথে আলোচনা করি। পরবর্তীকালে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে আসার পর দিল্লীতে অফিস স্থাপনে সক্ষম হই। অক্টোবরের শেষ দিকে মিসেস গান্ধীর সাথে বাংলাদেশ মন্ত্রী সভার একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকের আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আগামী শীতেই বাংলাদেশ প্রশ্নে একটা অবশ্যম্ভাবী ফয়সালা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বলতে গেলে অক্টোবর থেকেই আমরা ভারতের স্বীকৃতির জন্যে চাপ সৃষ্টি করতে থাকি।

 ১৫ই অক্টোবর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে স্বীকৃতির জন্যে পুনরায় অনুরোধ করেন। সেই চিঠিতে এটাও দাবী করা হয় যে বাংলাদেশের অর্ধেক ভূ-খণ্ড মুক্তিবাহিনীর দখলে ও বাংলাদেশ সরকারের শাসন ব্যবস্থা সেখানে চালু আছে। এই চিঠির সূত্র ধরে ১৫ই নভেম্বর অন্য একটি চিঠি লেখা হয়। সেই চিঠিতে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, স্বীকৃতির অনুরোধ, তৎকালীন অবস্থা ইত্যাদি ছিল। এই চিঠি লেখা হয় ইন্দিরার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রাক্কালে। ২৩শে নভেম্বর অপর একটি চিঠি লেখা হয় তাঁর সফর শেষে।

 এই চিঠিতে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ও বিশ্ব জনমতের প্রতি ইয়াহিয়ার চরম উপেক্ষার কথা বলা হয়। এই চিঠিতে আরো ছিল শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরার ব্যবস্থা করার কথা। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুরা শীতের আগে দেশে ফিরে যেতে না পারলে বিপজ্জনক অবস্থার সম্মুখীন হবে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এক চিঠিতে জানান, বাংলাদেশের দু’তৃতীয়াংশ মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকলেও পাক হানাদাররা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে হামলা করে সম্পদ ধ্বংস করছে। জবাবে ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সহযোগিতার প্রস্তাব করে। বাংলাদেশ সরকার ভারতের বন্ধুসুলভ সশস্ত্র বাহিনীকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও বেসামরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়।