পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১০৯

 পাক ভারত যুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠলো। স্বভাবতই বোঝা গেল পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যস্ত। অর্থাৎ পাকিস্তান আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে চাচ্ছে।

 এ সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতীয় সমর শক্তির সরাসরি যুদ্ধে অবতরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সরকারের কাছে এক জরুরী আবেদনে বলেন, বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার আগে ভারতীয় সেনাবাহিনী যেন বাংলাদেশে প্রবেশ না করে। আবেদনে আরো বলা হয়, একটি যৌথ বাহিনী গঠন করতে হবে এবং এই বাহিনী দু’দেশের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবে। তাছাড়া বাংলাদেশ মুক্ত হবার পর বাংলাদেশ যখন ইচ্ছা প্রকাশ করবে তখনই করবে তখনই ভারতীয় বাহিনীকে দেশ ত্যাগ করতে হবে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে দিল্লী থেকে ডি পি ধর কলকাতা আসেন। থিয়েটার রোড থেকে অন্য একটি বাড়িতে গিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে ডি পি ধরের দু’দিনব্যাপী আলোচনা হয়। রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনায় পারস্পরিক সমঝোতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে ভারত সরকার স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

 ৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতি দেয়ার এটা ছিল যথোপযুক্ত সময়। হানাদার বাহিনী তখন সেনানিবাসের ভেতরে আবদ্ধ। দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের শাসন ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। হানাদার বাহিনীকে তাড়াতে পারলেই দেশে যাওয়া সম্ভব।

 সীমান্তের ভেতরে-বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তখন উল্লাস দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। বিদেশী সাংবাদিকরা এসেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে। প্রধানমন্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তোমরা জানতে চাচ্ছ আমি কেমন আছি? সন্তানের জন্মের কথা জনক না জানলে তার মর্মব্যথা তোমরা বুঝ? আমি একটি ধাত্রীর কাজ করছি মাত্র। বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হয়েছে। আর তার জনক রয়েছেন হানাদারদের কারাগারে। জাতির জনক হয়তো কিছুই জানেন না। দুঃখে, ক্ষোভে, বেদনায় তাজউদ্দিন ভাই কেঁদে ফেলেন। তিনি অবিলম্বে জাতির জনককে মুক্তি দেয়ার দাবী করেন।

 ৭ই ডিসেম্বর যশোর সেনানিবাসের পতন হয়। এরপর আমি বেশীর ভাগ দিন কাটিয়েছি অগ্রগামী দলের সাথে।

 আমি যশোরে প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্যে রওয়ানা হই। পরদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যাবেন। অগ্রগামী দলে আমি ও মুস্তফা সারওয়ার ছিলাম। পথে পথে মানুষের বিপুল উল্লাস। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে চলছে। চারদিকে এই অস্ত্র দেখে মুস্তফা সারওয়ার উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, শান্তি শৃংখলা ফিরে আসবে তো?

 যশোর সার্কিট হাউসে ক্যাপ্টেন হুদার কাছে অস্ত্র জমা দেয়া হলো। পথে দেখলাম, ট্রাক ভর্তি করে হানাদার বাহিনী সদস্যদের নেয়া হচ্ছে। জনগন এদের মেরে ফেলতে চায়। বহু সাবধানে ও কড়া প্রহরায় এদের ভারতে নেয়া হয়।

 ভারতীয় বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোর অতি দ্রুত পুল, কালভার্ট মেরামত করে দেয়। কোথাও বেইলী ব্রিজ তৈরী করে দেয়া হয়।

 বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ছিলেন মুস্তফা সারওয়ার। রওশন আলীসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এসে আমাদের সাথে দেখা করেন। আমরা বেনাপোল সীমান্তে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাই। আমি ও মুস্তফা সারওয়ার সার্কিট হাউসের কক্ষে পাক সামরিক অফিসারের ব্যবহৃত পিস্তল ও কাপড় চোপড় পাই।