পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১১৪

 মার্চ মাসে যখন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে পাকিস্তানের শাসকের আলাপ আলোচনা শুরু হয় তখন স্বাভাবিকভাবে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠি। আমাদের মধ্যে এই ধারণা ছিল যে, সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে এবং এর ফলে বাঙ্গালীরা ও বাংলাদেশের মানুষ তাদের অধিকার লাভ করবে। এখানে বলা দরকার যে, সামরিক বাহিনী বাঙ্গালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এ রকম একটি আশংকা আমরা করেছিলাম। কিন্তু যখন আলোচনা শুরু হয় তখন আমাদের মনে হয়েছিল যে এই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম।

 ২৫ তারিখ ভোর ৪টার দিকে আমেরিকার পররাষ্ট্র বিভাগের একজন বন্ধু আমাকে ফোন করে খবর শুনতে বলেন। আমার নিজের বাসায় কোন রেডিও ছিল না তাই আমি গাড়ীতে গিয়ে রেডিও শুনি এবং ২৫শে মার্চের রাত্রির ঘটনা জানতে পারি। খবরটি শোনার পর একটা কথাই আমার বার বার মনে হচ্ছিল এবং সেটি হচ্ছে ‘পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটেছে’। দূতাবাসের অবস্থা কিছুটা অদ্ভুত ছিল কারণ আমরা দেশ থেকে সঠিক বা পুরো খবর পাচ্ছিলাম না। অতএব আমাদের প্রতিক্রিয়াও কিছুটা ভিন্ন হচ্ছিল। পাকিস্তানী কর্মচারীরা তখন বেশ হতবাক। তারা মোটেই জারিজুরি খাটাচ্ছিল না, বরং বলা যায় যে কিছুটা চুপচাপই ছিল।

 ২৯শে মার্চ সোমবার ওয়াশিংটনে বাঙ্গালীদের একটি সমাবেশ এবং বিক্ষোভ মিছিল হয়। কেপিটল হিল, হোয়াইট হাউস, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভবনের সামনে এই সমাবেশ হয়। প্রায় দুই শত মানুষ আসে এবং এদের মধ্যে বেশ কিছু সরকারী কর্মচারী এবং গবেষক ছিলেন। যথা জনাব সাফদার, জনাব খোরশেদ আলম, জনাব রহিম, অর্থনীতিবিদ মহিউদ্দিন আলমগীর, শামসুল বারি, ডঃ ইউনুস এবং আরো বেশ কয়েকজন। এখানে উল্লেখ করা উচিত যে, এই সমাবেশ আয়োজনে দূতাবাসের নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু তারাই ফোনের মাধ্যমে বেশিরভাগ যোগাযোগ স্থাপন করেন। সমাবেশ শেষ করার পর আমার বাসায় প্রায় ৭০ জন মিলিত হন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আমরা আলোচনা করি।

 পাকিস্তান দূতাবাসের অর্থনৈতিক কাউন্সিলর হিসেবে আমেরিকার সরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন মহলে আমার যোগাযোগ ছিল এবং আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, এদের সংগে আমার সংযোগগুলি আন্দোলনের পক্ষে ব্যবহারের চেষ্টা করবো। ষ্টেট ডিপার্টমেণ্টে ক্রেইগ ব্যাক্সাটার আমাদের সংগে সব সময় যোগাযোগ বেখেছিলেন। তিনি বহু তথ্য আমাদের দেন যেগুলো আমাদের আন্দোলনের পক্ষে আরো সহায়ক হয়ে উঠে। টাউনসেণ্ড সোয়েজি এইড দফতরে বাংলাদেশ ডেস্ক-এর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি আমাদের আন্দোলনের এমনই সমর্থন ছিলেন যে আমেরিকার নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। এছাড়া আরচার ব্লাড, যিনি ঢাকায় কনসাল জেনারেল ছিলেন বিভিন্ন ধরনের যেসব তথ্য প্রেরণ করেন সেসব কাহিনী ওয়াশিংটনে প্রকাশ পেলে আমাদের আন্দোলন আরও জোরদার হয়। এপ্রিলের শুরুতে হারভার্ডের ম্যসন, মার্গলিন ও ডর্ফম্যান বাংলাদেশ সমস্যার ওপর একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের সপক্ষে জনমত গড়তে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মার্গলিন ও পরে ডর্ফম্যান আলমগীর মহিউদ্দিনকে নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কংগ্রেসে জোর তদবির চালান। পয়লা এপ্রিল সিনেটর কেনেডী, সিনেটর হ্যারিস আর সিনেটর কেসের দফতরে আমি হাজির হই। এদের সঙ্গে যোগাযোগে আমার দুই বন্ধু, ওয়াশিংটন পোষ্টের রণ কোভেন এবং বিশ্বব্যাংকের মাইল ম্যাকুলক আমাকে সাহায্য করেন। এরা সবাই, এবং পরে সিনেটর মনডেল বাংলাদেশের সপক্ষে জোরালো বিবৃতি দেন। আমার বেশীরভাগ সময় কাটত বিশ্বব্যাংক, ষ্টেট ডিপার্টমেণ্ট, এইড, কংগ্রেস আর সংবাদপত্রের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ আলোচনায়। আমি তাদের এটাই বুঝাবার চেষ্টা করতাম যে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান কোনদিনই এক হবে না এবং এটা করার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তানকে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে বাংলাদেশের সংগে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে বাধ্য করা। আর এটা সম্ভব সাহায্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। কারণ পাকিস্তান যতই সাহায্য পাবে ততই সে তার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাবে।

 এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমি আমার কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাই কিন্তু দূতাবাসের ব্যবস্থায় এরপর পরিবর্তন হয়। এই সময় বাঙ্গালী প্রতিরোধের শেষ কেন্দ্রস্থল ভেংগে যাওয়ার পর পাকিস্তানীরা নিশ্চিন্ত হয় যে তাদের পুরোপুরি পক্ষে চলে গেছে এবং তারা তখন আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।